জবভ: প্রকাশের জন্য সংবাদ উধঃব: ৮ মার্চ ২০২৪
প্রেস বিজ্ঞপ্তি
চট্টগ্রামে হিল উইমেন্স ফেডারেশন’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও নারী দিবস পালিত
পাহাড়-সমতলে নারী সহিংসতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান
চট্টগ্রামে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে আজ শুক্রবার (৮ মার্চ ২০২৪) বিকাল ৩ টায় হিল উইমেন্স ফেডারেশন চট্টগ্রাম নগরের চেরাগী পাহাড়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক আসর ও সমাবেশের আয়োজন করে।
সমাবেশে বক্তারা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে নারীর ওপর সহিংসতার বিরুদ্ধে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বানসহ পাহাড়ি নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সেনা-সেটলার প্রত্যাহার, কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌসসহ তার দোসরদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, লংগুদুতে নিজ স্কুল ছাত্রীর ধর্ষক আব্দুর রহিমসহ দেশে ধর্ষণ-খুন ও গুমের অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ এবং পাহাড়-সমতলে সুষ্ঠু ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবি জানান।
“পাহাড়-সমতলে ধর্ষণ, রাষ্ট্রীয় মদদে খুন-গুম-সন্ত্রাস ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলুন” এই আহ্বানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমার সভাপতিত্বে ও রূপসী চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের চট্টগ্রাম পূর্ব-৩ সভাপতি অ্যাডভোকেট ভুলন ভৌমিক, বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমান, বাংলাদেশের সাম্যবাদী আন্দোলন’র কেন্দ্রীয় পাঠচক্র ফোরামের সদস্য অপু দাশ গুপ্ত, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সভাপতি কণিকা দেওয়ান, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সভাপতি জিকো ত্রিপুরা বাংলাদেশ নারী মুক্তি কেন্দ্রের চট্টগ্রাম জেলার সদস্য দীপা মজুমদার ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরা।
প্রতিষ্ঠার তিন যুগপূর্তিতে অভিবাদন জানিয়ে সংগঠনের সভানেত্রী নীতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিবাদী নারীদের সাহসী ঠিকানা হিল উইমেন্স ফেডারেশনের পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠার ৩যুগপূর্তিতে সংগ্রামী অভিবাদন! স্বৈরশাসক এরশাদের শাসনামলে এক কঠিন সময়ে গঠিত হবার পর থেকে হিল উইমেন্স ফেডারেশন দীর্ঘপথ পরিক্রমা করে বর্তমান পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সংগঠন বিশ্বস্ততার সাথে জনগণের লড়াই সংগ্রামে নিয়োজিত আছে। নারীসমাজ সমাজের দালাল-প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের লেজুড় সুবিধাবাদীদের ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছে, আপোষনামার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পূর্ণস্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যুক্ত হয়েছে। প্রতিষ্ঠার তিন যুগপূর্তিতে আমরা দৃপ্ত কণ্ঠে এ ঘোষণা দিতে চাই, আমরা প্রতিবাদী নারীসমাজ দমন-পীড়নে হার মানব না, লড়াই সংগ্রামে থাকবো!
পার্বত্য চট্টগ্রামে যৌন সহিংসতা তুলে ধরে নীতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে গত বছরে যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটে ২৩ টি। তারমধ্যে ১০টি ধর্ষণ ও গণধর্ষণ, ৮টি ধর্ষণের প্রচেষ্টা। ২টি অপহরণের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনাগুলোর কয়েকটিতে অপরাধীদের নামমাত্র গ্রেফতার দেখানো হলেও উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করা হয়নি এবং অপরাধীদের সাজা নিশ্চিত করেনি। সারা দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে উল্লেখ করে নারী নেত্রী নীতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু রাখা হয়েছে। ফলে খুনী, অপরাধী, ধর্ষক দুর্বৃত্তদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। অবৈধ সরকার অপরাধীদের আস্কারা দেবে, এতে অবাক হবার কিছু নেই। সরকার-প্রশাসন অপরাধী ধর্ষকদের বিচার ও সাজা দিতে ব্যর্থ। কারণ সরকার অবৈধ, বিচার করার নৈতিক জোর সরকারের নেই। স্পষ্ট ভাষায় বলতে গেলে, সরকারই জনগণের আদালতে অপরাধী। জনগণ এ সরকারকে ভোট দেয় নি। পাহাড়ে ২৭টি ভোটকেন্দ্রে (খাগড়াছড়িতে ১৯, রাঙ্গামাটিতে ৮) একটি ভোটও পড়েনি। এতগুলো কেন্দ্র নিল গেছে! এটাই সরকারের প্রতি অনাস্থার বড় দৃষ্টান্ত।এ সরকারকে গণআন্দোলনের মাধ্যমে ফেলে দিতে না পারলে, পাহাড় সমতলে কেউই নিরাপদে থাকতে পারবে না। হিল উইমেন্স ফেডারেশনরে লড়াই সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, হিল উইমেন্স ফেডারেশন প্রতিষ্ঠার লগ্ন থেকে শাসকগোষ্ঠী রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে লড়াই সংগ্রাম করে যাচ্ছে। শাসকগোষ্ঠীর অন্যায় নিপীড়ন বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদিকা কল্পনা চাকমা লেফটেন্যান্ট ফেরদৌস গঙ কর্তৃক অপহৃত হয়েছেন। কল্পনা অপহরণের ২৮ বছর হলেও কোন সরকার তার বিচার করে নি।
ফিলিস্তিন সংহতি দিবসে সংহতি জানাতে গিয়ে আমাদের সংগঠনের তৎকালীন সভানেত্রী নিরূপা চাকমা ও দপ্তর সম্পাদক দ্বিতীয়া চাকমা পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হন এবং জেল খেটেছেন। কল্পনা অপহরণকারীদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে আন্দোলন করতে গিয়ে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সদস্য এন্টি চাকমাসহ ২২ জন সাহসী বোন বিজিবি’র লাঠিপেটায় জখম হয়ে দীর্ঘদিন কারাবরণ করেছেন। গত বছরে ২৩ সেপ্টেম্বরে প্রীতিলতার আত্মাহুতি দিবসে কর্মসূচি সফর করে বাঘাইছড়ি থেকে ফেরার পথে এইচডব্লিউএফের সদস্য এন্টি চাকমাসহ দুই কলেজ ছাত্রীকে অপহরণ করে এই শাসকগোষ্ঠীর দোসররা। তারই ধারাবাহিকতায় গত পরশু দিনও খাগড়াছড়ি কলেজে পরীক্ষা দিতে গিয়ে দুই কলেজ ছাত্রীকে শাসকগোষ্ঠীর দোসর অপহরণ করতে চেয়েছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেহেতু এ ঘটনা ঘটে প্রিন্সিপালের মাধ্যমে পুলিশের সহায়তায় বাসায় পৌঁছলেও পরের দিন সেনাসৃষ্ট মুখোশরা তাদের নিয়ে গিয়ে হুমকি, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে ছেড়ে দেওয়া হয়। পাহাড়ে খাগড়াছড়ি শহরে অসংখ্যা নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা সক্রিয় থাকার পরও পাহাড়ে এ অরাজকতা চলছে। শাসকগোষ্ঠী তা করাচ্ছে। পেশির জোরে আইন আদালত সব কিছু হাতের মুঠে রেখে শাসকগোষ্ঠী দেশকে মগের মুল্লুক বানিয়েছে। তিনি, পাহাড়-সমতলে দমন-পীড়ন নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্যলড়াই সংগ্রামে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানান।
মাহফুজুর রহমান বলেন, পাহাড়ে কল্পনা চাকমা অপহরণ ও সমতলে সাগর-রুনি হত্যার বিচার হয়নি। আমরা যে রাষ্ট্রের কাঠামোতে বাস করছি সেখানে নানান ত্রুটি রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে যদি ৫৯ ও ৬০ নং ধারা বাস্তবায়ন করা হত তাহলে পার্বত্য চট্টগ্রামে জেলা উপজেলা ও ইউনিয়নে স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত হতো। পাহাড়ি জনগণের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার প্রতিষ্ঠা হতো।
ভ্লুন ভৌমিক বলেন, নারীরাও মানুষ তাদেরক পণ্য হিসেবে উত্থাপন করা চলবে না। নারীদের আত্ম-সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার দিতে হবে।
অপু দাশ গুপ্ত বলেন, পুঁজিবাদী সমাজে নারীদের কোন নিরাপত্তা নেই। বাংলাদেশের জনগণকে জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
কণিকা দেওয়ান বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যতদিন পর্যন্ত সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হবে না ততদিন পর্যন্ত নারীরা নিরাপদ নয়। কাজেই পাহাড়ি নারীদের নিরাপত্তার স্বার্থে পাহাড় থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার ও সেটলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সমতলে সম্মানজনক পুনর্বাসন করতে হবে। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সম্মান ও আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার যতদিন প্রতিষ্ঠা হবে না ততদিন লড়াই চলবে বলে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।
জিকো ত্রিপুরা বলেন, পাহাড় সেনাশাসনের কারণে খুন-গুম-অপহরণ বেড়েছে। এই সেনাশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, আন্দোলন করতে হবে।
দীপা মজুমদার বলেন, নারী দিবসের চেতনা লড়াই-সংগ্রাম আর প্রতিবাদ প্রতিরোধের। সরকার পাহাড়-সমতলে নারী ধর্ষণের ঘটনার কোন বিচার করছে না। তাই লড়াই সংগ্রাম গড়ে তেলার মাধ্যমে এই বিচার ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
সমাবেশে ছাত্র নেতা অমল ত্রিপুরা বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিবাদী সরকার গত ৭ জানুয়ারিভোটার বিহীন ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় গিয়েদেশকে এক কঠিন সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে।একদলীয় শাসনের যাঁতাকলে পাহাড়-সমতলে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, মুক্তমনা চিন্তাশীল ব্যক্তি ও স্বাধীন মতপ্রকাশের ওপর দমন-পীড়ন জারি রেখেছে। সম্প্রতি পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই মাসে বিপুল-সুনীল-লিটনসহ পিসিপি, যুব ফোরাম ও ইউপিডিএফ-এর ৯জন নেতা-কর্মীদের হত্যা করা হয়েছে। ছাত্র লীগ কর্তৃক জাহাঙ্গীনগর বিশ^বিদ্যালয়ে এক নারীকে গণধর্ষণের ঘটনার পর ধর্ষণ বিরোধী গ্রাফিতি আঁকারদায়ে আমাদের বন্ধুপ্রতিম ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের দুই নেতাকে বহিষ্কার করা হয়েছে বিশ^বিদ্যালয়। দ্রব্যমূল্যা উর্ধ্বগতি, ব্যাংক লুটপাট ও অর্থপাচারের প্রতিবাদে ঢাকায় গণতন্ত্র মঞ্চে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ হামলা করেছে। তিনি আরো বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচে’ বেশি আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দুর্বল, প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু জাতি ও সম্প্রদায়ের লোকজন। এক অবর্ণনীয় দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে তারা। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে নারীদের ওপর সহিংসতা বেড়েছে। মহিলা পরিষদের প্রদিবেদনের মতে গত ফেব্রুয়ারিতে ২২২ জন নারী-শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। নারীরাঘরে-বাইরে, স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়ে, পথে-ঘাটে, ক্ষেত-খামারে, কলকারখানা-অফিস কিংবা আদালতে সব জায়গায় নারীরা চরম অনিরাপদে ভুগছে।
সমাবেশের আগে একটি বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। শোভাযাত্রাটি চট্টগ্রাম ডিসি হিল থেকে শুরু হয়ে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাব এলাকা প্রদক্ষিণ করে চেরাগী পাহাড় মোড়ে এসে সমাবেশে মিলিত হয়। এরপর প্রতিরোধ সাংস্কৃতিক স্কোয়াড’র শিল্পীবৃন্দ প্রতিবাদী নৃত্যনাট্য পরিবেশন করেন। এতে পার্বত্য চট্টগ্রামের নব্য পাক বাহিনী ও পাহাড়ি দালাল-প্রতিক্রিয়াশীল কর্তৃক পাহাড়ি নারীদের ওপর সহিংসতা ও নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরা হয়।
বার্তা প্রেরক
এন্টি চাকমা
সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি
হিল উইমেন্স ফেডারেশন