আন্তর্জাতিক ডেস্ক: নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কায় পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন দেশটির রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) নেতা রনিল বিক্রমাসিংহে। জনসাধারণের তীব্র আপত্তি আর বিরোধিতার পরও মঙ্গলবার পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে তিনি দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। গণআন্দোলনের মুখে গত সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়েছিলেন রনিল। দেশটির আন্দোলনকারীরা সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, রনিল বিক্রমাসিংহে আবারও প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিলে দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি শান্ত হবে না। এমনকি আন্দোলন চালিয়ে যাবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন তারা। বুধবার দেশটির ইংরেজি দৈনিক ডেইলি মিররের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংসদে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে জয় পেয়েছেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন স্পিকার। শ্রীলঙ্কার ২২৫ আসনের সংসদে রনিল বিক্রমাসিংহে ১৩৪ সংসদ সদস্যের ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।

অন্যদিকে, তার প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দল শ্রীলঙ্কা পদুজনা পেরামুনার (এসএলপিপি) নেতা দুলাস আলহাপ্পেরুমে ৮২ ভোট এবং দেশটির বামপন্থী রাজনৈতিক দল জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়েকে মাত্র ৩ ভোট পেয়েছেন। একজন সংসদ সদস্য ভোটদানে বিরত ছিলেন এবং অপর এক সদস্য সংসদে অনুপস্থিত থাকায় প্রেসিডেন্টের জয়ের জন্য ১১২ ভোট প্রয়োজন ছিল।

দেশকে অর্থনৈতিক পতনের হাত থেকে বের করে আনা এবং কয়েক মাস ধরে চলমান গণবিক্ষোভের পর শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে মরিয়া দায়িত্ব পালন করছেন বিক্রমাসিংহে। এর আগে, গত সপ্তাহে দেশটির আন্দোলনকারীরা বাসভবন দখলে নেওয়ার পর শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে মালদ্বীপ পালিয়ে যান। পরে সেখান থেকে তিনি সিঙ্গাপুর পাড়ি জমান।

দেশটির বিক্ষোভকারীরা রনিল বিক্রমাসিংহেরও পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছেন। গত মে মাসে চরম সংকটের মুখে মাহিন্দা রাজাপাকসের পদত্যাগের পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়েছিলেন রনিল। বিক্ষোভকারীরা তার ব্যক্তিগত বাসভবন জ্বালিয়ে দিয়েছেন। একই সঙ্গে কলম্বোতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দখল নেন তারা। তখন থেকেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও এখন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়া রনিলের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে আসছেন আন্দোলনকারীরা। কিন্তু সেই দাবির প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পদত্যাগ করবেন না বলেও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।

গোতাবায়া রাজাপাকসে পালিয়ে যাওয়ার পর সংবিধান অনুযায়ী দেশটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের শপথ নিয়েছিলেন রনিল বিক্রমাসিংহে। বুধবার সংসদে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় আগামী ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন তিনি। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে দেশের ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের জন্য খাদ্য, জ্বালানি এবং ওষুধের মতো গুরুত্বপূর্ণ আমদানি করতে পারছে না শ্রীলঙ্কা। দেশটিতে মূল্যস্ফীতি প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এক বছর আগের তুলনায় খাদ্যের দাম ৮০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চলতি বছর মার্কিন ডলার এবং অন্যান্য প্রধান বৈশ্বিক মুদ্রার বিপরীতে শ্রীলঙ্কার রুপির মূল্য হ্রাস পেয়েছে।

অনেকে দেশটির চলমান এই পরিস্থিতির জন্য সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেকে দায়ী মনে করেন। তাদের মতে, রাজাপাকসের ভুল নীতির কারণে শ্রীলঙ্কায় বর্তমান সংকট তৈরি হয়েছে। আর এই সংকটের প্রভাব করোনাভাইরাস মহামারির কারণে আরও প্রবল হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে শ্রীলঙ্কা বিপুল পরিমাণ ঋণ করেছে। দুই দশকের মধ্যে এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রথম দেশ হিসেবে গত মাসে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়েছে। দেশটির কর্মকর্তারা ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেলআউটের জন্য আইএমএফের সাথে আলোচনা করছেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণে এই আলোচনা আপাতত থমকে গেছে। এখন দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে পুনরায় আইএমএফের সাথে বেলআউটের আলোচনা শুরু করাই হবে বিক্রমাসিংহের অন্যতম চ্যালেঞ্জ। ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি এবং সুদের হার বৃদ্ধি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, উচ্চমাত্রার ঋণ এবং বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার মতো একই ধরনের বৈশ্বিক প্রতিকূলতা বাংলাদেশসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করতে পারে আশংঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এক নজরে শ্রীলঙ্কা: ভারতের দক্ষিণের এক প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে দেশটি। শ্রীলঙ্কার ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের ৯৯ শতাংশই প্রধানত তিনটি জাতিগত গোষ্ঠী সিংহলিজ, তামিল এবং মুসলিম। রাজাপাকসে ভাইদের পরিবার বছরের পর বছর ধরে দেশটি শাসন করেছে। কয়েক দশকের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের পর ২০০৯ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল বিদ্রোহীদের পরাজিত করে দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিজদের কাছে ‘বীর’ বনে যান মাহিন্দা রাজাপাকসে। মাহিন্দার ভাই গোতাবায়া রাজাপাকসে সেই সময় দেশটির প্রতিরক্ষা সচিব ছিলেন। পরে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি। যদিও গণবিক্ষোভের মুখে গত সপ্তাহে দেশ ছেড়ে সিঙ্গাপুরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা: শ্রীলঙ্কার সংবিধান অনুযায়ী— রাষ্ট্র, সরকার এবং সামরিক বাহিনীর প্রধান প্রেসিডেন্ট। তবে অনেক নির্বাহী দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর সাথে ভাগাভাগি করতে হয় প্রেসিডেন্টকে। আর প্রধানমন্ত্রী দেশটির সংসদের ক্ষমতাসীন দলের প্রধানের দায়িত্ব পান।

সূত্র: বিবিসি, ডেইলি মিরর শ্রীলঙ্কা।

খবরটি 441 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen