জবভ: প্রকাশের জন্য সংবাদ                                 উধঃব: ৯ নভেম্বর ২০২৩

সংবাদ বিজ্ঞপ্তি

মানিকছড়িতে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা বিরোধী প্রতিরোধ সমাবেশ, কুশপুত্তলিকা দাহ ও নারী আত্মরক্ষা কমিটি গঠন

সদ্য গঠিত নারী আত্মরক্ষা কমিটি সদস্যদের আত্মরক্ষার কৌশল প্রদর্শন

খাগড়াছড়ির মানিকছড়িতে ধর্ষণ ও যৌন সহিংসতা বিরোধী প্রতিরোধ সমাবেশ করেছে হিল উইমেন্স ফেডারেশন, নারী আত্মরক্ষা কমিটি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ।

সমাবেশ শুরুর আগে বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড নিয়ে এক বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। ধর্ষণ ও দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে মিছিলকারীদের মুহুর্মুহু শ্লোগানে রাজপথ প্রকম্পিত হয়। মিছিলে ধর্ষক সেনা-সেটলার ও দালাল-প্রতিক্রিয়াশীলদের কুশপুত্তলিকা বহন করা হয়। পাহাড়িদের সমাজে তীব্র ঘৃণা ও ধিক্কার জানাতে মিছিলকারীরা এক পর্যায়ে কুশপুত্তলিকা শুকরের মতো বহনের ও চেষ্টা করে।

আজ বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর ২০২৩) সকাল ১১ টায় মিছিলটি মানিকছড়ি গিরি মৈত্রী সরকারি ডিগ্রি কলেজ গেইট থেকে শুরু হয়ে উপজেলার পোস্ট অফিস সড়ক প্রদক্ষিণ করে ধর্মঘরে এসে সমাবেশে রূপ নেয়। এতে মানিকছড়ি, গুইমারা, মাটিরাঙ্গা, রামগড়, লক্ষীছড়িসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ২,৭০০ জনের অধিক নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করে।

‘রাস্তাঘাট, ক্ষেত-খামার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান-কর্মস্থল ও যানবাহনসহ সর্বত্র নারীর সম্ভ্রম ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার’ লক্ষ্যে আহূত বিশাল এই প্রতিবাদ সমাবেশে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমার সভাপতিত্বে নারী আত্মরক্ষা কমিটির কেন্দ্রীয় সদস্য রিপনা চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) মানিকছড়ি ইউনিটের সমন্বয়ক ক্যহ্লাচিং মারমা, লক্ষীছড়ি ইউনিটের সংগঠক আপ্রুসি মারমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম কেন্দ্রীয় তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক রজেন্টু চাকমা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ খাগড়াছড়ি জেলা কমিটি তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক বাহাদুর ত্রিপুরা। সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন মারমা ওয়েলস ফেয়ার এসোশিয়েসন-এর প্রতিনিধি এচিং মারমা, সাবেক মহিলা মেম্বার ম্রাচিং মারমা ও সাবেক মেম্বার সদুঅং মারমা। এতে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।

সমাবেশ শুরু করার আগে ৪৭ সদস্য বিশিষ্ট মানিকছড়ি উপজেলা নারী আত্মরক্ষা কমিটি ঘোষণা করা হয়। এ সময় কমিটির সদস্যরা সংগঠনের আনুষ্ঠানিক সূচনা তুলে ধরতে আত্মরক্ষার সংক্ষিপ্ত কসরৎ প্রদর্শন করে। নব গঠিত কমিটির আহ্বায়ক মিলি মারমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মাধ্যমে সমাবেশ আরম্ভ করা হয়।

সমাবেশে ইউপিডিএফের সংগঠক ক্যহ্লাচিং বলেন, এই মানিকছড়িতে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রতিনিয়ত ভূমি বেদখল অব্যাহত রয়েছে ও নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এখানে ধর্ষণ হলে পুলিশ-প্রশাসন অপরাধীর পক্ষালম্বন করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের জাতিগত নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য মুছে ফেলার জন্য সেনা-সেটলার, মুখোশ-দালাল দিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে। মানিকছড়ি-গুইমারায় সেনা-প্রশাসনের প্রত্যক্ষ আশ্রয়-প্রশ্রয়ে নব্য মুখোশ বাহিনী অপহরণ-মুক্তিপণ আদায়সহ দুষ্কর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। বন্দুকের ভয় দেখিয়ে আমাদের দমিয়ে রাখা যাবেনা। কীভাবে সংগ্রাম করতে হয়, তা আমরা জানি। এ সরকারের ষড়যন্ত্র কোনো দিন সফল হবেনা। আমরা পূর্ণ সায়ত্ত্বশাসন কায়েমের লক্ষ্যে লড়াই করছি। গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত করে আমরা আন্দোলন চালিয়ে নেবো। পার্বত্য চট্টগ্রামে যাতে আর কোনো দিন ভূমিহারাতে না হয়, তার জন্য সবাইকে সতর্ক ও সংগঠিত হওয়ার আহ্বান জানান। জননেতা ক্যহ্লাচিং পার্বত্য অব্যাহত ভূমি বেদখল ও নারী নির্যাতনের পরিপ্রেক্ষিতে জনসংহতি সমিতির নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় উস্মা প্রকাশ করেন। সমিতির নেতৃত্বকে সরকারের তাঁবেদারি ছেড়ে জনগণের আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানান।

সমাবেশে নীতি চাকমা বলেন, আত্মরক্ষা প্রকৃতির প্রথম আইন। আত্মরক্ষা করতে গিয়ে যদি আক্রমণকারী দ্বর্ুৃত্ত মারাও যায়, সেটি কোনো অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হবেনা। ক্ষমতাসীন সরকারের তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, যারা প্রান্তিক, যারা দুর্বল সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। এদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর নিপীড়ন নির্যাতন হলে বিচার হয়না। এ যাবত কালে আমরা কোনো ঘটনারই সুষ্ঠু বিচার পাইনি। রাষ্ট্রকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করতে হয়। ‘দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন’সরকার তা মানছেনা। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের ধর্ম হচ্ছে অপরাধী-দোষীদের শায়েস্তা করা। আর যারা ভালো এবং দুর্বল তাদেরকে রক্ষা করা। কিন্তু এই সরকার নিগৃহীত ও আক্রান্ত তাদের নিরাপত্তা দিচ্ছেনা। সে কারণে নারীদের নিজেদেরই আত্মরক্ষা করতে হবে। আজকের সময়ের দাবিতে নারী আত্মরক্ষা কমিটি গঠন খুবই জরুরি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। নাগরিক হিসেবে আমরা মান-সম্মান অধিকার নিয়ে জীবন-যাপন করি, রাষ্ট্র তা চায় বলে মনে হয় না। নারীরা শিক্ষা দীক্ষা লাভ করবে, যোগ্যতার সাথে চাকরি করবে স্বাবলম্বী হবে, তার কোনো পরিবেশ নেই। কারণ স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, ক্ষেত-খামার, কর্মস্থল ও রাস্তার যানবাহন কোনো জায়গা নারীদের জন্য নিরাপদ নয়। সব খানে নারীদের আক্রান্ত হতে হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী মোতায়েন ও সেটলার পুনর্বাসনের পর থেকে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। সেনা-সেটলারই পাহাড়ে নারী নিরাপত্তার প্রধান হুমকি।

আমরা যদি দেখি ২০২০ সালে খাগড়াছড়ি বলপিয়ে আদামের ধর্ষণের ঘটনা, লংগদুতে এক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে প্রধান শিক্ষক কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনা। এতে ধর্ষকরা গ্রেফতার হলেও সুষ্ঠু বিচার হয় নি। এর আগেও অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। কাজেই নারী সমাজের আর বসে থাকার কোনো অবস্থা নেই। কারণ এখন বিচারের জন্য কোর্টে গেলেও ন্যায় বিচার মেলেনা। আইনের ফাঁক গলিয়ে যারা দুষ্কৃতকারী, অপরাধী তারা জামিন পায়। আমরা লংগদুতে ধর্ষক আব্দুর রহিমের হাইকোর্টের বিচারিক কার্যক্রম লক্ষ্য করেছি। নি¤œ আদালত যদি পক্ষপাতিত্ব করতো তাহলে না হয় কথা ছিল। কিন্তু দেখা গেছে হাইকোর্টও সুষ্ঠু ও ন্যায় বিচার করছেনা, প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। আমাদের আস্থার জায়গা কমে গেছে। আমরা আর কোনো জায়গায় নিরাপদ নই। পাহাড়ে উপর্যপুরি নারী ধর্ষণ, অব্যাহত ভূমি বেদখল থেকে শুর ুকরে সর্বক্ষেত্রে দমন-পীড়ন তীব্র হচ্ছে। এ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে আমরা নারী আত্মরক্ষা কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়েছি। এই সরকার হচ্ছে অবৈধ সরকার। নারীদের সম্ভ্রম রক্ষা ও নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। যারা প্রান্তিক, দুর্বল তাদের সুরক্ষা দিতে পারেনা। শুধু পাহাড়ি নয় এই অবৈধ সরকার যারা বৃহত্তর বাঙালি জাতিগোষ্ঠী, তাদের ওপরও অত্যাচার চালাচ্ছে। এই অবৈধ সরকারের হাতে পাহাড়ি বাঙালি সবাই এখন নিষ্পেষিত। অবৈধ সরকারকে উৎখাত করে দেশে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সবাইকে সংগঠিত হওয়ার জন্য তিনি জোর আহ্বান জানান।

সমাবেশে যুবনেতা রজেন্টু চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি নারীরা কোথাও নিরাপদ নয়। শুধু তাই নয় সারাদেশে সড়কের নিরাপত্তার অব্যবস্থাপনার ফলে জনগণের দূর্ভোগ পোহাতে হয়। সাম্প্রতিক সময়ে কাপ্তাই ৬ সেনা সদস্য কর্তৃক ধর্ষণের ঘটনা, মানিকছড়ির চক্কিবিলের ধর্ষণের ঘটনাসহ রামগড়েও ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতরা গ্রেফতার হলেও সুষ্ঠু বিচার হয় না, দুর্বৃত্তরা দৃষ্টান্তমূলক সাজা পায়না। সে কারণে বারবার ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। পাহাড়ে নিরাপত্তার নামে সেনা, পুলিশ মোতায়েন আছে। কিন্তু বাস্তবে তারা রক্ষকের নামে ভক্ষকের ভূমিকা পালন করছে। সে কারণে সেনা প্ররোচনা ও অংশগ্রহণে নারী ধর্ষণ, ভূমি বেদখল, পাহাড়ি উচ্ছেদ ও পাহাড়ি গ্রামে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে চলেছে। তিনি এসব দুর্বৃত্ত ও ভূমি দস্যুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

ছাত্র নেতা বাহাদুর ত্রিপুরা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশ ব্যাপী বৃহৎ বাঙালি জাতির পাশাপাশি আমরা পাহাড়ি সংখ্যালঘুরা আজ নিরাপত্তা হীন। আজকে সারাদেশ ব্যাপীতে যে যৌন সহিংসতা তা বিরাট আকার ধারণ করেছে। ১৯৮০ সালে সমতল থেকে পার্বত্য এলাকায় নিয়ে আসা বহিরাগত সেটলাররা প্রতিনিয়ত কোননা কোন জায়গায় ভূমি বেদখল করে চলেছে। আমাদের পাহাড়ি নারীদের সম্ভ্রমহানি করছে, ধর্ষণ করছে, কিন্তু তার সঠিক বিচার হচ্ছেনা।

সমাবেশে বক্তারা অবিলম্বে ধর্ষকদের কঠোর সাজা দেওয়ার আহ্বান জানান। এলাকায় এলাকায় সংগঠিত করে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।

সমাবেশে শেষে ধর্ষক সেনা-সেটলার, দালাল-প্রতিক্রিয়াশীলদের প্রতীকী হিসেবে কুশপুত্তলিকায় জুতা-স্যান্ডেল দিয়ে পেটানো হয়, ক্ষুব্ধনারী ও যুবকরা লাথি মেরে ঘৃণা প্রকাশ করে। এ সময় প্রতিবাদী শ্লোগান ধ্বনিত হয়, ক্ষুব্ধনারী ও ছাত্র-যুব-জনতা ধর্ষণ ও দালালি-প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশের অংশ হিসেবে কুশপুত্তলিকা দাহ করে।

বার্তা প্রেরক

(এন্টি চাকমা)

সদস্য, হিল উইমেন্স ফেডারেশন

কেন্দ্রীয় কমিটি।

খবরটি 477 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen