স্বাস্থ্য ডেস্ক: বাংলাদেশে একটা সময় ছিল যখন চাহিদার প্রায় ৮০ ভাগ ওষুধ আমদানি করা হতো। স্বাধীনতার পর প্রায় অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতির চাহিদা পূরণের জন্য ন্যূনতম জরুরী ওষুধের জন্য তাকিয়ে থাকতে হতো বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের ওষুধ শিল্পের চিত্র পাল্টে গেছে। আমদানির পরিবর্তে জরুরী প্রয়োজনীয় ওষুধের ৯৮ ভাগের বেশি উৎপাদন হচ্ছে দেশে। শুধু তাই নয়, দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি করা হচ্ছে বিশ্ব বাজারে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের ওষুধের বাজার প্রায় ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। উৎপাদিত ওষুধ রফতানি হচ্ছে ১৫৭ দেশে। বেশ কয়েকটি দেশীয় কোম্পানি উন্নত দেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পেয়েছে গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস বা জিএমপি সনদ। ধারাবাহিক রফতানি বাড়ায় খাতটি দেশের অর্থনীতিতে তৈরি করেছে সম্ভাবনার নতুন আলো। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, তৈরি পোশাক খাতের পর বিকল্প শিল্প হিসেবে ওষুধ শিল্প দেশের অর্থনীতিতে পালন করতে পারবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পের অগ্রযাত্রার ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, দেশে এ শিল্পের যাত্রা শুরু পঞ্চাশের দশকে, ওই সময় ভারতীয় উপমহাদেশের এই ভূখন্ডে ওষুধ কোম্পানি ছিল না বললে চলে। ১৯৪০ সালে প্রথম ড্রাগ এ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়েছিল; যা অবিভক্ত ভারতের তৎকালীন স্বাস্থ্য পরিষেবা অধিদফতরের অধীনে ছিল। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত এটি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য পরিষেবা অধিদফতর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এটি স্বাস্থ্য অধিদফতর রূপে পুনর্গঠন করা হয়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশীয় ৪৬ কোম্পানির ৩০০ ধরনের ওষুধপণ্য বিশ্ববাজারে রফতানি হয়। শুধু ওষুধ রফতানিতে বিশ্ববাজার থেকে বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা বা এলডিসি হিসাবে ওষুধশিল্পে মেধাস্বত্ব ছাড় ১৭ বছর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাংলাদেশের ওষুধশিল্প খাতে ২০৩৩ সাল পর্যন্ত মেধাস্বত্ব ছাড় পাচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ওষুধ রফতানির আকার বাড়াতে চায় বাংলাদেশ। এই খাতের উত্থানে রয়েছে কিছু প্রতিবন্ধকতা। বিশেষ করে গ্যাস ও বিদ্যুত এ শিল্প প্রসারে প্রধান বাধা। এসব সমস্যার সমাধান হলে বিশ্ব বাজারে তৈরি পোশাক খাতের পাশাপাশি ওষুধ শিল্প খাত মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

            ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে বিশ্বের প্রায় ১১৩টি দেশে প্রায় ৯০ মিলিয়ন ডলারের ওষুধ রফতানি হয়েছে। একইভাবে ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ১৪০টি দেশে রফতানি হয়েছে মোট ১০৪ মিলিয়ন ডলারের ওষুধ। ২০১৮-২০১৯ সালে ১৪৬টি দেশে রফতানি হয় ১৩০ মিলিয়ন ডলারের ওষুধ। ক্রমবর্ধমান রফতানির এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরেও। এসময় ১৪৮টি দেশে রফতানি ১৩৬ মিলিয়ন ডলারের ওষুধ। এখন ২৮৪ ধরনের এ্যালোপ্যাথি, ইউনানি ২৮২, আয়ুর্বেদিক ২০৩, হোমিওপ্যাথিক ৭১, হারবাল ৩সহ মোট ৮৭৭ ধরনের ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে দেশেই। দেশে বর্তমানে মোট ফার্মেসির পরিমাণ ১৫ লাখ ৫ হাজার ৫৮৯টি। পিছিয়ে নেই ভ্যাকসিন উৎপাদনেও। দেশীয় কোম্পানি ইনসেপ্টা মোট ৯ ধরনের ভ্যাকসিন উৎপাদন করছে। একই সঙ্গে পপুলার ফার্মাসিউটিক্যাল উৎপাদন করছে ৩ টি ভ্যাকসিন। ফলে দেশে মোট ১২ ধরনের ভ্যাকসিন উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশীয় কোম্পানি গ্লোব বায়োটেক করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন উৎপাদনেরও দাবি করছে। যা সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায়। পাকিস্তান আমলে অধিকাংশ বহুজাতিক কোম্পানির কারখানা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। একাত্তরের স্বাধীনতার কিছুদিন পর ওষুধ উৎপাদন শুরু করে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা লাভের পর ওষুধ শিল্প পুনরায় যাত্রা শুরু করে। শুরুতে মোট চাহিদার মাত্র ২০ ভাগ বাংলাদেশ উৎপাদন করতে সক্ষম ছিল। আর ৮০ ভাগ নির্ভর করত বৈদেশিক আমদানির ওপর। এসময় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ওষুধ বিক্রি করতে বিভিন্ন অজুহাতে অনীহা দেখায়। পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশের ওষুধ সংস্থা পণ্যের বিনিময়ে (পাট ও অন্যান্য কাঁচামাল) বাংলাদেশে ওষুধ সরবরাহে রাজি হয়। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত দেশের প্রায় ৭০ ভাগ ওষুধের বাজার ছিল আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া দখলে। ১৯৮২ সালে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পর বিদেশী ওষুধ কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া বাণিজ্য থেকে দেশীয় ওষুধ শিল্প মুক্তি পায় এবং আস্তে বাজার সম্প্রসারণ শুরু করে। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বাজারজাত বন্ধ করে দেয়া হয় এবং স্বাস্থ্য সেবার প্রতিটি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ বৃদ্ধি করা হয়। প্রতিযোগিতামূলক বাজারের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ওষুধের মূল্য তুলনামূলকভাবে কম এবং ভোক্তার ক্রয় ক্ষমতার নাগালে রাখার ব্যবস্থা নেয় সরকার।

            ওষুধ শিল্প সমিতি সূত্রে জানা যায়, এখন মাত্র ২ শতাংশ ওষুধ আমদানি করা হচ্ছে, অবশিষ্ট ৯৮ শতাংশ স্থানীয় কোম্পানিগুলো দেশেই তৈরি করছে। বিশ্ববাজারে ওষুধ রফতানিতে বিশেষ শর্ত শিথিলের সুবিধাভোগী দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ হিসাবে ওষুধ রফতানি করে থাকে। চলতি বছরের মধ্যেই ওষুধ রফতানি ৬ বিলিয়ন ডলার এবং আগামী ১০ বছরে ১৭ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার প্রত্যাশা নিয়ে কাজ করছে সরকার। ওষুধ শিল্প দেশের ৯৮ শতাংশ চাহিদা মেটায়। বিগত চার দশক থেকে এই শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। ওষুধের বৈশ্বিক বাজারের হিসাবে দেখা যায়, ২০১৮ সালের হিসাবে বিশ্বব্যাপী ওষুধের বাজার এক হাজার ২০৫ বিলিয়ন ডলার, যার ৪.০৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। পাঁচ বছরে গড়ে ৩ থেকে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ২০২৩ সালে এই বাজার দাঁড়াবে এক হাজার ৫০৫ বিলিয়ন থেকে এক হাজার ৫৩৫ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বে ওষুধে ব্যয় ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে এটি ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশ ওষুধ রফতানি করেছে ১৩ কোটি ডলার, যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ছিল ১০ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ওষুধ রফতানি হয়েছে ১৩ কোটি ৫৭ লাখ ডলার। আগের বছরের চেয়ে ওষুধ রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪.৪৯ শতাংশ এবং সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর মাসের রফতানি প্রতিবেদনে বলা হয়Ñএই সময়ে রফতানি হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ২৮ শতাংশ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ২৬৯টিরও বেশি ছোট-বড় ওষুধ কারখানা রয়েছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, এসব এ্যালোপ্যাথিক ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বছরে ২৪ হাজার রকমের ১২ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার ওষুধ ও ওষুধের কাঁচামাল উৎপাদন করে। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি কোম্পানি উন্নত দেশের ওষুধ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস বা জিএমপি সনদ লাভ করেছে। প্রয়োজনীয় ওষুধ উৎপাদনের সব প্রযুক্তি বিদ্যমান থাকায় বাংলাদেশের ওষুধশিল্প বর্তমানে প্রায় সব ধরনের ওষুধ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করেছে। বেশকিছু শীর্ষ ওষুধ কোম্পানি এরই মধ্যে বৈশ্বিক ওষুধ খাতের বড় কিছু সনদ অর্জন করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যগুলো হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এফডিএ, যুক্তরাজ্যের এমএইচআরএ, ইউরোপের ইইউ, অস্ট্রেলিয়ার টিজিএ।

            বাংলাদেশে ওষুধ শিল্প প্রসারের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এসএম শফিউজ্জামান বলেন, ১৯৮১ সালে দেশে লাইসেন্সকৃত ওষুধ কারখানার সংখ্যা ছিল ১৬৬টি। তবে ওষুধ উৎপাদনে তখন ৮টি বহুজাতিক কোম্পানির আধিপত্য বজায় ছিল এবং তারা এককভাবে শতকরা ৭৫ ভাগ ওষুধ সরবরাহ করত। সে সময় ২৫টি মাঝারি আকারের দেশীয় ওষুধ কোম্পানি শতকরা ১৫ ভাগ এবং ১৩৩টি কোম্পানি বাকি ১০ ভাগ ওষুধ তৈরি করত। এসব কোম্পানি বার্ষিক ৬০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানিকৃত কাঁচামাল থেকে স্থানীয়ভাবে ওষুধ তৈরি করত। তিনি বলেন, দেশে ১৬৬টি স্থানীয় ওষুধ কোম্পানি থাকা সত্ত্বেও প্রতিবছর ৩০ কোটি টাকা মূল্যের তৈরি ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশের ফলে প্রয়োজনীয় ওষুধ তৈরির কাঁচামাল এবং দেশে উৎপাদিত হয় না এমন জীবন রক্ষাকারী ওষুধ আমদানি করা হয়। এর ফলে স্থানীয়ভাবে তৈরি ওষুধের মূল্য ১৯৮১ সালের হিসাবে ১১০ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৯৯ সালে ১,৬৯০ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ওই অবস্থা থেকে বর্তমানে ওষুধের মোট চাহিদার শতকরা ৯৮ ভাগ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ওষুধ দ্বারা মেটানো হচ্ছে।

খবরটি 445 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen