জাতীয় ডেস্ক: রায়ের কপি (অনুলিপি) পেতে বিচারপ্রার্থীদের যাতে ঘুরতে না হয় সেজন্য বিচারপতিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে।ছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। একই সঙ্গে চলমান মামলার সংখ্যা আয়ত্তে আনতে তাদের আরও বেশি কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। সুপ্রিমকোর্ট দিবস-২০২০ উপলক্ষে শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে তিনি এ আহ্বান জানান।

সুপ্রিমকোর্ট অডিটোরিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ তাই মনে রাখতে হবে একজন বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার পাওয়া তার অধিকার। আর নাগরিকের সে অধিকার নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এখানে দয়া বা আনুকূল্যের কোনো বিষয় নেই। দেশ, জনগণ ও সংবিধানের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে বিচারক, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট সবাই তাদের মেধা ও মনন প্রয়োগের মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করবেন। সুপ্রিমকোর্ট দিবসে এটাই সবার প্রত্যাশা। আবদুল হামিদ বলেন, আমি নিজে একজন আইনজীবী হিসেবে জানি বিচারকাজ কত কঠিন ও জটিল।

বিচার কার্যক্রম পরিচালনায় একজন বিচারককে কতটা পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু এরপরও আমি বলব, মামলা দিন দিন যে হারে বাড়ছে সেটাকে আয়ত্তের মধ্যে আনতে হলে বিচারকদের আরও বেশি কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, সরকার বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এবং বিচারকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু বিচারকদের খেয়াল রাখতে হবে মামলার রায় হওয়ার পর রায়ের কপি পাওয়ার জন্য বিচারপ্রার্থীদের যাতে আদালতের বারান্দায় দিনের পর দিন ঘোরাঘুরি করতে না হয়।

দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিতে আইনজীবীদের আন্তরিকতা সততার সঙ্গে সমর্থন প্রত্যাশা করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, আইনজীবীরা বিচার ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অংশ। আইনজীবীদের সহায়তা ছাড়া বিচারের কাজ কিছুতেই অগ্রসর হতে পারে না। আমাদের সংবিধান প্রণয়নের সময় যেমন দেশের প্রথিতযশা আইনজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, তেমনি যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই আদালতের ডাকে সাড়া দিয়ে আইনজীবীরা এমিকাস কিউরি হিসেবে তাদের মতামত দিয়ে আদালতকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করেছেন।

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, সুপ্রিমকোর্ট দিবসের অনুষ্ঠানে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আইনজীবীদের অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করছি। আমি আশা করি, জ্ঞানের চর্চায় আইনজীবীরা আগের চেয়ে আরও এগিয়ে যাবেন এবং তাদের মেধা, প্রজ্ঞা, সততা ও আন্তরিকতা দিয়ে বিচারপ্রার্থীদের দ্রুত ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে সাহায্য করবেন।

রাষ্ট্রপতি বলেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার অন্যতম হল শান্তি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সবার জন্য ন্যায়বিচারের সুযোগ তৈরি করা। উন্নয়নের সঙ্গে ন্যায়বিচার এবং আইন-আদালতের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একটা কথা মনে রাখতে হবে, বিরোধের মীমাংসা যথাযথভাবে না হলে আস্থার সংকট সৃষ্টি হবে। আর এ প্রক্রিয়া বারবার চলতে থাকলে রাষ্ট্র ও সমাজে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন, বিচার ব্যবস্থা প্রাথমিকভাবে বিরোধ নিষ্পত্তি করে জনগণের ক্ষোভ প্রশমন করে। এতে সমাজে বৈষম্য দূরীভূত হয় এবং রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। আর এভাবেই টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হয়।

নাগরিকদের আয় ও সুবিধার ভিন্নতা বা আর্থিকভাবে অসচ্ছলতার কারণে কেউ যাতে ন্যায়বিচার বা আইনের সমান আশ্রয় লাভ থেকে বঞ্চিত না হয় তা নিশ্চিত করতে জাতীয় আইনগত সহায়তা সংস্থা গঠিত হয়েছে। আশা করি, এর মাধ্যমে দেশের আদালতে আর্থিকভাবে অসচ্ছল ও দুর্গত বিচারপ্রার্থীরা মামলার শুরু থেকে নিষ্পত্তি হওয়া পর্যন্ত সব আইনগত সহায়তা পাবে।

প্রযুক্তি ব্যবহার প্রসঙ্গে আবদুল হামিদ বলেন, তথ্যপ্রযুক্তি এখন আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের এ সময়েও মানুষের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আদালত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে বিচারকার্য পরিচালনার জন্য ২০২০ সালের ৯ মে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। যা পরবর্তী সময়ে আইনে পরিণত হয়। ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে বিচার কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে আদালত প্রাঙ্গণে শারীরিক উপস্থিতি ব্যতিরেকে বিচারপ্রার্থী জনগণের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এজন্য আমি এ কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, বর্তমানে সুপ্রিমকোর্টে অনলাইন কজলিস্ট চালু হয়েছে এবং অনলাইন বেল কনফার্মেশন ব্যবস্থা কার্যকরভাবে চলছে। একইভাবে আদালতের সব কার্যক্রম ডিজিটাল পদ্ধতিতে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। সুপ্রিমকোর্ট যেহেতু ‘কোর্ট অব রেকর্ড’ সেহেতু এর সব নথি এবং মামলা দায়ের থেকে রায় ঘোষণা পর্যন্ত সব কার্যক্রমকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি বলে আমি মনে করি।

৭৫-পরবর্তী সময়ের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, নিজেদের স্বার্থে জাতীয় সংসদকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে ৫ম ও ৭ম সংশোধনী এনে সেসব কুকীর্তিকে বৈধতা দেয়ার হীন চেষ্টা করেছিল।সুপ্রিমকোর্ট সংবিধানের ৫ম ও ৭ম সংশোধনীকে অবৈধ ঘোষণা করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ড ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে দেশে আইনের শাসন সুসংহত করতে সুপ্রিমকোর্ট প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে।

বিচারকদের প্রশংসা করে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- জাতির ক্রান্তিকালে যখনই প্রয়োজন হয়েছে তখনই সুপ্রিমকোর্ট মানুষের মৌলিক মানবাধিকার ও সংবিধানকে রক্ষা করেছে এবং করে যাচ্ছে। তাই সুপ্রিমকোর্ট দিবসের অনুষ্ঠানে আমি কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি সুপ্রিমকোর্টের সেসব অকুতোভয় বিচারপতিদের যারা বন্দুকের নলের কাছে নতি স্বীকার না করে এবং নিজেদের বিবেককে বিকিয়ে না দিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন।

সভায় বিশেষ অতিথি আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, কোভিড-১৯ এর পিকটাইমে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছেন। এ সময় বিচারকরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনা করে কঠিন দুঃসময়েও দেশে বিচার কাজ চালু রেখেছেন যা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। এর মাধ্যমে গোটা বিচার বিভাগের দক্ষতা ও সক্ষমতারও পরিচয় ফুটে উঠেছে। বিচার বিভাগের আজকের অবদানের পেছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানও অনস্বীকার্য।

আইনমন্ত্রী আরও বলেন, সুপ্রিমকোর্টের ৪৮ বছরের পথচলায় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বহু উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। দেরিতে হলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও জেলহত্যা মামলার বিচার এবং ১৯৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের অবদান ভোলার নয়। দেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল তা থেকে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে এসব হত্যাকাণ্ডের বিচারের কথা জাতি আজীবন স্মরণ রাখবেন। তিনি বলেন, আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি সুপ্রিমকোর্ট সম্পূর্ণ স্বাধীন। কিন্তু এ অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য যে কঠিন সংগ্রাম করতে হয়েছিল তা স্মরণ না করলে ভবিষ্যৎ পথচলায় ভ্রান্তি হতে পারে।

স্মরণ রাখতে হবে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কালরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর দীর্ঘ ২১ বছর একটি মামলা পর্যন্ত রুজু হয়নি। বরং এ হত্যাকাণ্ডের বিচার যাতে না হয় সেজন্য ইনডেমনিটি অর্ডিন্যাস জারি করা হয়েছিল। জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে বহুবার কোর্টে গেছেন। তার ক্ষেত্রে বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদেছে। এক অদৃশ্য অপশক্তির ভয়ে তখনকার কোর্টগুলো এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। পিতার হত্যাকাণ্ডের বিচার পাওয়ার জন্য তাকে সরকারে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম, অ্যাটর্নি জেনারেল ও সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এএম আমিন উদ্দিন, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টে’ স্মারক গ্রন্থের ডিজিটাল সংস্করণ উন্মোচন করা হয়। এছাড়া সুপ্রিমকোর্টের ইতিহাসের ওপর একটি তথ্যচিত্র দেখানো হয়।

খবরটি 684 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen