বিশেষ খবর ডেস্ক: ভূমি ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত একটি আইনের সুপারিশ করেছে আইন কমিশন। এ লক্ষ্যে ‘ভূমি আইন, ২০২২’ নামে নতুন একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছে সংস্থাটি। দীর্ঘ প্রায় চার বছর ধরে গবেষণা ও পর্যালোচনা শেষে সম্প্রতি নতুন এ আইনের খসড়া সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রচলিত ১০টি পুরনো আইন স্থগিতের সুপারিশ করে প্রস্তুত নতুন খসড়া আইনে ৩০২টি ধারা ও ১৭টি অধ্যায় রয়েছে। খসড়াটি কমিশনের ওয়েবসাইটেও প্রকাশ করা হয়েছে।

            সমন্বিত আইন করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে কমিশনের সুপারিশপত্রে বলা হয়েছে ১৮৮৫ সালের “দ্য বেঙ্গল টেন্যান্সি অ্যাক্ট”, ১৮৭৫ সালের “দ্য সার্ভে অ্যাক্ট” এর মাধ্যমে ভূমি ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনয়নের চেষ্টা করা হলেও তা খুব একটা সুফল বয়ে আনেনি। ফলে ১৯৩৮ সালে এ অঞ্চলের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন আনয়নের উদ্দেশ্যে “দ্য ল্যান্ড রেভিনিউ কমিশন” গঠন করা হয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় ভারত বিভাগোত্তর পূর্ব বাংলায় “দ্য ইস্ট বেঙ্গল স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০” প্রণয়ন করে জমিদার শ্রেণি অবলুপ্তকরণের মাধ্যমে ভূমি মালিকদের সরাসরি সরকারের প্রজায় রূপান্তরিত করা হয়। এটিই বর্তমানে এ অঞ্চলের ভূমি মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত প্রধান আইন। তবে এর পাশাপাশি ভূমি রাজস্ব, ভূমি মালিকানা ও ভূমির ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আরও বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন আইন প্রচলিত থাকে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে দেশের সংবিধান প্রণীত হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের জনগণকে প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার উৎস হিসেবে অভিহিত করা হয়। এ কারণে অন্তত তাত্ত্বিকভাবে হলেও ভূমি মালিকদের আর রাষ্ট্রের প্রজা হিসেবে বিবেচনা করা সম্ভব নয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই দ্য স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্টসহ ভূমিসংক্রান্ত প্রচলিত অন্য আইনসমূহে ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

            আইন কমিশন থেকে করা খসড়া আইন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভূমি ব্যবস্থাপনায় আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির প্রচলন ও ডিজিটাল জরিপের বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। জনগণের ভোগান্তি দূর করার উদ্দেশ্যে সঠিকভাবে ভূমি জরিপ করতে ও ভূমির তথ্য ডিজিটালি সংরক্ষণের বিষয়গুলো মাথায় রেখেই এ খসড়া আইন তৈরি করেছে কমিশন। খসড়া আইনের তৃতীয় অধ্যায়ের ৪৮ থেকে ১৫৩ ধারা পর্যন্ত ভূমি জরিপ ও ভূমি রেকর্ড বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। সুপারিশপত্রে বলা হয়েছে- সঠিক ভূমি জরিপ ও এর নির্ভুল রেকর্ড ভূমি ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি। ভূমি জরিপের মাধ্যমে ভূমি মালিকদের স্বত্বলিপি প্রদান করা হয়। ১৮৭৫ সালের দ্য সার্ভে অ্যাক্ট প্রণীত হওয়ার পর থেকে ভূমির মালিকানার কাগজ প্রস্তুত বা পরিমার্জন বা পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয় ভূমি জরিপ বিভাগকে। দ্য বেঙ্গল অ্যাক্ট, ১৮৮৫-এর মাধ্যমে ভূমি মালিকানা নির্ধারণ ও রায়তি স্বত্ব প্রদানে বিস্তারিত নিয়ম ঘোষণা করা হয়। এসব আইনের নির্দেশনা মোতাবেক ভূমি জরিপ হাতে কলমে সম্পাদন করা হতো। এমনকি বাংলাদেশে সর্বশেষ জরিপও হাতে কলমে সম্পন্ন হয়েছে। হাতে কলমে করা জরিপে বহু ভ্রান্তি থাকা স্বাভাবিক এবং একটি জরিপ সম্পাদনের বহু ভুল ধরা পড়ছে। এ কারণে এ খসড়ায় সর্বশেষ প্রাপ্ত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে জরিপ সম্পাদনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

            সুপারিশপত্রে আরও বলা হয়েছে- জরিপকালে ভুল সংশোধনের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের ধারা পাওয়া যায় ১৮৮৫ সালের বেঙ্গল টেন্যান্সি অ্যাক্টের ১১৫(সি) ধারা থেকে। তবে প্রথমে ‘দ্য স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট, ১৯৫০-এ ট্রাইব্যুনালের কোনো বিধান ছিল না। এ আইনের ১৪৪ এ ধারায় বলা হয়, সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা ভুল প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত জরিপ বিভাগ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত খতিয়ান সঠিক মর্মে গণ্য হবে এবং দেওয়ানি কার্যবিধি মোতাবেক সাক্ষ্যপ্রমাণ দ্বারা ভুল নির্ধারণের জন্য দেওয়ানি আদালতের আশ্রয় নেওয়া যেত। ২০০৪ সালে জরিপকালে ভুল সংশোধনের জন্য ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় এবং ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারাধীন বিরোধীয় বিষয়াবলি সম্পর্কে দেওয়ানি আদালতে আশ্রয়ের বিধান রহিত করা হয়। এ ছাড়া ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালের আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের জন্য আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠনের বিধান রাখা হয়। বর্তমান খসড়া আইনেও জরিপ বা চূড়ান্ত প্রকাশিত খতিয়ানসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ১৫৪ ধারার আওতায় ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল স্থাপের এবং এর কার্যপদ্ধতি সম্পর্কিত বিধান করা হয়েছে ১৫৬ ধারায়। এ ধরনের বিরোধ সম্পর্কে ১৫৭ ধারা অনুসারে কোনো দেওয়ানি আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করা যাবে না। ১৫৫ ধারার আওতায় ল্যান্ড সার্ভে আপিল ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের বিধান করা হয়েছে।

            ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে ভূমি ব্যবস্থাপনায় আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি প্রচলনের উদ্দেশ্যে ১৬৫ ধারায় রেকর্ড হালকরণসংক্রান্ত তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশের বিধান, ১৬৭ ধারায় জিওরেফারেন্সিং-পূর্বক ডিজিটাইজ করে ভেক্টর ডাটা সংরক্ষণ এবং সব খতিয়ানের তথ্য ডাটাবেজে ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণের মাধ্যমে নকশা ও খতিয়ান হালকরণসংক্রান্ত বিধান, জালিয়াতি রোধকল্পে ১৬৮ ধারায় ডিজিটাল নিরাপত্তার স্বার্থে বিভিন্ন ধাপে কপি সংরক্ষণের বিধান এবং ১৬৯ ধারায় ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রতিটি দাগের মালিকানা নির্ধারণ ও খতিয়ান প্রস্তুতের বিধান নতুনভাবে সংযোজন করা হয়েছে। ভূমি রেকর্ড সংরক্ষণ ও হালকরণ বিষয়ে রাজস্ব কর্মকর্তার আদেশের বিরুদ্ধে ১৭১ ও ১৭২ ধারার আওতায় কালেক্টরের কাছে আপিল দায়ের করা যাবে, কালেক্টর নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হলে অথবা কালেক্টরের আদেশ দ্বারা কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তিনি দেওয়ানি আদালতে মোকদ্দমা দায়ের করতে পারবেন। খসড়া আইনের পঞ্চম অধ্যায়ে ভূমি হস্তান্তর, বন্ধক ও হস্তান্তর-পরবর্তী রেকর্ড; ষষ্ঠ অধ্যায়ে ভূমি উন্নয়ন কর ধার্য ও পরিশোধ সংক্রান্ত বিধানাবলি; সপ্তম অধ্যায়ে সরকারি জমি, পতিত জমি ও গণব্যবহার্য জমি ব্যবস্থাপনা; অষ্টম অধ্যায়ে শিকস্তি ও পয়স্তি জমি, নদী জলাশয়, সাগর ও উপকূল; নবম অধ্যায়ে সায়রাতমহাল; দশম অধ্যায়ে কৃষি ও অকৃষি জমি সুরক্ষা; একাদশ অধ্যায়ে তটভূমি ব্যবস্থাপনা; দ্বাদশ অধ্যায়ে চাবাগান; ত্রয়োদশ অধ্যায়ে রাবারবাগান, ফলবাগান ইত্যাদি; চতুর্দশ অধ্যায়ে অর্পিত সম্পত্তি; পঞ্চদশ অধ্যায়ে ওয়াকফ, দেবোত্তর, ট্রাস্ট সম্পর্কিত ভূসম্পত্তি, কোর্ট অব ওয়ার্ডস সম্পত্তি ইত্যাদি এবং ষষ্ঠদশ অধ্যায়ে দখল, নামজারি, অংশবণ্টন, নকশার ভুল, সীমানা নির্ধারণ, অবৈধ দখল ও অবৈধ দখল উচ্ছেদ এবং সপ্তদশ অধ্যায়ে বিধি প্রণয়ন, রহিতকরণ ও হেফাজত বিষয়ে তুলে ধরা হয়েছে।

খবরটি 386 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen