ফিচার ডেস্ক: জাতির পিতাকে হত্যার পর আমরা দুইবোন রিফিউজি হিসেবে ৬ বছর বাস করেছি। নাম-পরিচয়টাও ব্যবহার করতে পারিনি। কিন্তু আমাদের প্রতিজ্ঞা ছিল সুযোগ পেলে দেশকে গড়ে তুলব। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে যেন দেশে ফিরি। অনেক বাধাবিপত্তি, অনেক অপপ্রচার শুনতে হয়েছে। লক্ষ্য স্থির করে চলেছি বলে আজকে লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছি এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

            প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ আগস্ট, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারের নির্মমভাবে হত্যা করে স্বাধীনতা বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র। ওই সময় শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেলজিয়াম থাকায় বেঁচে যান। ওই দিন শেখ হাসিনা কী অবস্থায় ছিলেন, কীভাবে জানলেন তিনি বলেন জীবনের মর্মদস্তু কাহিনী।
শেখ হাসিনার জীবন ও সংগ্রাম: গণজাগরণের কাব্য’ বই সূত্রে জানা যায়, শেখ হাসিনার স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া প্রথম জানেন বঙ্গবন্ধু সপরিবারের নিহত হওয়ার খবর। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ফোন করে এ তথ্য জানান। ওই সময় তাঁদের প্যারিস যাওয়ার কথা ছিল তা বাতিল হয়ে যায়। পরে তাঁরা জার্মানির বন শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। স্বামীর কাছ থেকেই শেখ হাসিনা জেনেছিলেন পরিবারের সদস্যদের নিহত হওয়ার কথা। কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন দু’বোন।

            ড. ওয়াজেদ মিয়ার ভাষ্যমতে: ১৫ আগষ্ট (১৯৭৫) শুক্রবার সকাল সাড়ে ছয়টায় ঘুম ভাঙ্গে ম্যাডাম রাষ্ট্রদূতের ডাকে। তিনি জানান যে, জার্মানীর বন থেকে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী আমাদের জন্য ফোন করেছেন। প্রথমে হাসিনাকে পাঠিয়ে দিই তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু দুই-এক মিনিটের মধ্যে ফিরে এসে হাসিনা আমাকে জানায় যে, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলতে চান। হাসিনাকে তখন ভীষণ চিন্তিত ও উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছিল। আমি দ্রুত নীচে দোতলায় চলে যাই। তখন সেখানে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অবস্থায় মাথা হেঁট করে রাষ্ট্রদূত সাহেব ধীরে ধীরে পায়চারী করছিলেন। আমাকে দেখেও তিনি কোন কথা বললেন না। ফোনের রিসিভারটি ধরতে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে বললেন, আজ ভোরে বাংলাদেশ ‘ক্যু-দে-টা’ হয়ে গেছে। আপনারা প্যারিস যাবেন না। রেহানা ও হাসিনাকে এ কথা জানাবেন না। এক্ষুণি আপনারা আমার এখানে বনে চলে আসুন। প্রকৃতপক্ষে কি ঘটেছে, একথা আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এর বেশি আপাততঃ আমি আর কিছুই জানিনা। একথা বলেই তিনি আমাকে ফোনের রিসিভারটি সানাউল হক সাহেবকে দিতে বললেন। অতঃপর আমি আস্তে আস্তে তিনতলায় আমাদের কক্ষে চলে যাই। সেখানে পৌছাতেই হাসিনা অশ্রুজড়িত কণ্ঠে আমার কাছ থেকে জানতে চায় হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেব আমাকে কি বলেছেন। তখন আমি শুধু বললাম যে, তিনি আমাদেরকে প্যারিস যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিল করে সেদিন বনে ফিরে যেতে বলেছেন। একথা বলেই আমি বাথরুমে ঢুকে পড়ি। সেখানে এটাসেটা ভাবতে ভাবতে বেশ খানিকটা সময় কাটাই। ততক্ষণে রেহানা সজাগ হয়ে আমাদের কামরায় চলে আসে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতে রেহানা ও হাসিনা দু’জনই কাঁদতে কাঁদতে বলে যে, নিশ্চয়ই কোন দুঃসংবাদ আছে যা আমি তাদেরকে বলতে চাই না। তারা এও বলে যে, প্যারিসে না যাওয়ার কারণ তাদেরকে পরিস্কারভাবে না বলা পর্যন্ত তারা ঐ বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবে না। অতএব, বাধ্য হয়ে আমি তাদেরকে বলি যে, বাংলাদেশে কি একটা মারাত্নক ঘটনা ঘটে গেছে যার জন্য আমাদের প্যারিস যাওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে না। একথা শুনে তারা দু’বোন কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তাদের কান্নায় ছেলেমেয়েদের ঘুম ভেঙ্গে যায়।
১৫ আগষ্ট (১৯৭৫) সকাল সাড়ে দশটার দিকে আমরা বনের উদ্দেশ্যে ব্রাসেলস ত্যাগ করি। পথে রেহানা ও হাসিনা সারাক্ষণ কান্নাকাটি করে। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে আমরা বনে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের বাসায় পৌছাই। সেদিন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন যুগোশ্লাভিয়ায় সফর শেষে বাংলাদেশে ফেরার পথে ফ্রাংকফুর্টে যাত্রাবিরতি করে হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের বাসায় উঠেছেন। হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী সাহেবের স্ত্রী, ডঃ কামাল হোসেন ও হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী তিনজন মিলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়া রেহানা ও হাসিনাকে ধরাধরি করে বাসার ভেতর নিয়ে যান। ড্রইংরুমে এভাবে কিছুক্ষণ কাটানোর পর হুমায়ুন রশীদ সাহেবের স্ত্রী হাসিনাদের ওপর তলায় নিয়ে যান। তখন ড্রইংরুমে ড. কামাল হোসেন, হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী ও আমি ভীষণ উৎকণ্ঠিত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্থ অবস্থায় বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অন্যান্য রেডিও ষ্টেশন থেকে বাংলাদেশের তখনকার পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করতে থাকি। এরই এক ফাঁকে আমি হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে ঘরের বাইরে নিয়ে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে ১৫ আগষ্টের ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানতে চাই। নিরাপদ স্থানে না পৌছানো পর্যন্ত হাসিনাদের আমি কোন কিছু জানতে দেবো না, এই শর্তে তিনি আমাকে বললেন, বিবিসি এর এক ভাষ্যানুসারে রাসেল ও বেগম মুজিব ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই এবং ঢাকাস্থ ব্রিটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত বিবরনীতে বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউই বেঁচে নেই। এই পরিস্থিতিতে আমাদের কোথায় আশ্রয় নেয়া নিরাপদজনক হবে, তাঁর কাছ থেকে একথা জানতে চাইলে তিনি বললেন, উদ্ভুত পরিস্থিতিতে একমাত্র ভারত ছাড়া আর কোন দেশ আপনাদের জন্য নিরাপদ নয়। [শেখ হাসিনার জীবন ও সংগ্রাম: গণজাগরণের কাব্য পৃষ্ঠা ৩৭-৩৯]

খবরটি 507 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen