জাতীয় ডেস্ক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি অসম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করে এদেশে কাউকে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, তার ছোট ভাই রাসেলের মতো আর কোন শিশুকে যাতে হত্যার শিকার হতে না হয়, সেজন্য তার সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এদেশে সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম পালন করবে। আমাদের সংবিধানে তা বলা আছে। ইসলামে সে কথা বলা হয়েছে। মহানবী (স.) বলেছেন, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না। সুতরাং আমরা চাই ধর্ম নিয়ে যেন কেউ বাড়াবাড়ি না করে। এ দেশে সবাই শান্তিতে বসবাস করবে। মঙ্গলবার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেলের ৫৮তম জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একথা বলেন। তিনি গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীর ২৩ বঙ্গবন্ধু এভেনিউস্থ দলের কেন্দ্রিয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই সভায় ভার্চুয়ালি সভায় অংশগ্রহণ করেন। জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের পাশাপাশি গৃহহীণকে ঘর করে দেয়া তার সরকারের লক্ষ্য উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই দেশে একটি শিশুর মেধা ও জ্ঞান যাতে যথাযথভাবে বিকষিত হবার সুযোগ পায় এবং সে বাংলাদেশকে যেন সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। কারণ এত রক্ত ক্ষয় এত কিছু বাংলাদেশে ঘটে গেছে। এ ধরনের ঘটনা আর যেন না ঘটে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী এদিন মন্ত্রি পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে কুমিল্লায় গুজবকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পূজা মন্ডপে হামলা ও গোলাযোগ সৃষ্টিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর শান্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে নির্দেশ দেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, তার বাবার আদর্শ নিয়েই এদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এবং এদেশে আর শিশুরা যাতে কোনরকম নির্মমতার শিকার না হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের এখনও মাঝে মাঝে সেই নির্মমতা আমরা দেখি এবং এটা যেন আর না হয়। কারণ দেখেছি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে কিভাবে মানুষগুলোকে হত্যা করা হয়েছে, শিশুদের পর্যন্ত। খালেদা জিয়া বিরোধি দলে থাকার সময় তার অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার হয়েছে মানুষজন। বাবা দেখেছে তার চোখের সামনে কিভাবে জ্যান্ত সন্তান আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছে। সে রকম নিষ্ঠুর ঘটনাওতো দেশে ঘটেছে এবং এটাই হচ্ছে সবথেকে দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের। আমি এইটুকুই চাইব এখানে মানবতার প্রশ্ন যারা তোলে তারা যেন এই ঘটনাগুলো ভাল ভাবে দেখে যে, বাংলাদেশে কি ঘটতো। কিন্তু আমরা সরকারে আসার পর আমাদের প্রচেষ্টা কোন শিশু রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে না টোকাই থাকবেনা। তাদের যেন একটা ঠিকানা থাকে তারা যেন একটু ভালভাবে বসবাস করতে পারে। যখন বিরোধী দলে ছিলাম তখন চেষ্টা করেছি, এখনও চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে এই দেশের শিশুরা তাদের লেখাপড়া, তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা, তারা যেন নিয়মিত স্কুলে যেতে পারে। যেমন আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি, সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ, সেটা তৈরি করার জন্য তাদের প্রস্তুত করা, তাদের ট্রেনিং দেওয়া, সব রকম ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। শিশুর নিরাপত্তা, শিশু অধিকার আইন তো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে করে দিয়ে গেছেন। প্রাথমিক শিক্ষাটাকে অবৈতনিক, বাধ্যতামূলক করে দিয়ে গেছেন।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর দেশে খুনীদের রক্ষায় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই হত্যাকান্ডের বিচার করা হবে না বলে আইন করা হলো এদেশে। বাবা-মা-ভাইসহ পরিবারের সদস্যদের হত্যার বিচার চাইতে পারিনি, আমাকে একটি মামলা করতে দেয়া হয়নি। বিশ্বে যারা মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেন, তখন তারা কোথায় ছিলেন? বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর খুনীদের দায়মুক্তি দিতে শুধু আইন করা নয়, খুনীদের রাষ্ট্রদূত বানিয়ে পুরস্কৃত করা, প্রহসনের নির্বাচনে খুনীদের এনে সংসদে বসানোর ঘটনা ঘটেছে। জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী খালেদা জিয়া এসব কাজ করেছে। সাবেক সেনা শাসক জিয়াউর রহমানের সময় সেনাবাহিনী নাকি অনেক ‘ডিসিপ্লিনড’ ছিল এবং ‘শক্তিশালী’ ছিল। কতিপয় বিএনপি নেতৃবৃন্দের দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী সে সময় ১৯টি ক্যু সংঘটিত হওয়া, সেই ক্যু’কে কেন্দ্র করে হাজার হাজার সামরিক বাহিনীর অফিসার হত্যার অভিযোগ উত্থাপন করেন। সেখানে আমার প্রশ্ন ’৭৫ থেকে ’৮১ এই সময়ের মধ্যে ১৯টি ক্যু যখন হয় একটি দেশে সেখানে একটি দেশের সেনাবাহিনী ‘শক্তিশালী’ ও ‘ডিসিপ্লিনড’ থাকে এ দাবি করে কোন মুখে। জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর একজন অফিসার হয়েও সে জাতির পিতার হত্যার সঙ্গে যে জড়িত শুধু তাই নয়, সেতো হাজার সেনা ও বিমান বাহিনীর অফিসার হত্যা করেছে। ৭৫ এর পর দিনের পর দিন আওয়ামী লীগের নেতাদের কারাগারে বন্দি করে অমানবিক অত্যাচার করেছে। যা পরবর্তীতে অব্যাহত রেখেছে। কাজেই তাদের মধ্যে মানবতাবোধ কিছু ছিলনা এখনও নাই। জাতির পিতার হত্যাকান্ডের খুনীদের বিচারের পর যখন অনেকের ফাঁসির রায় হলো তখন ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে না পারার কারণে খালেদা জিয়া সেই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। এমনকি খালেদা জিয়া তাদের ডেকে এনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে পুণর্বাসন করে। এমনকি প্রমোশন দেয়। খায়রুজ্জামানকে প্রমোশন দিয়ে মালয়েশিয়ায় রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে দেয়। খুনী পাশাকে মৃত্যুর পর প্রমোশন দেয়া হয়। খালেদা জিয়ার খুনীদের প্রতি এই পক্ষপাতিত্বের কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, কারণ খুনী মোশতাকের সঙ্গে জিয়াউর রহমান সম্পূর্ণভাবে এই খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল। ছোট ভাই শেখ রাসেলকে সর্বশেষ হত্যা করা হয়। বলা হয়েছিল, ওই ছোট্ট শিশুটি যেন না বাঁচে। এই নির্দেশটা কে দিয়েছিল? কারা দিয়েছিল? সব শেষে সব লাশ মাড়িয়ে শেখ রাসেলকে হত্যা করা হলো, সবচেয়ে এটাই বড় কষ্টের।

প্রধানমন্ত্রী ম্মৃতি রোমন্থর করে বলেন, আমাদের বড় চার ভাই-বোনের শেখ রাসেল ছিল অত্যন্ত আদরের, কিন্তু বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত ছিল। বঙ্গবন্ধু দিনের পর দিন কারাগারে বন্দী অবস্থায় অবুঝ শিশু রাসেলের মনের কষ্টের কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বড়বোন শেখ হাসিনা বলেন, কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধু যখন মুক্তি পেতেন, তখন রাসেল কোনভাবে বাবাকে চোখের আড়াল করতে চাইতো না। খেলা-ধুলা বা পড়ার টেবিল থেকে কয়েক মিনিট পর পর বাবার কাছে ছুটে আসতো। মনে তার একটা ভয় ছিল, বাবা আছে কি না। কারাগারে গেলে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে আসতে চাইতো। বাড়িতে ফিরে সারারাত ঘুমাতো না, কাঁদতো। এমন কষ্ট নিয়ে বড় হচ্ছিল আমার ছোট ভাই শেখ রাসেল। তিনি রাসেল সম্পর্কে আরও বলেন, রাসেল ছোটবেলা থেকে সহজ-সরল ছিল। তার কোনো দাবি ছিল না। তার স্বপ্ন ছিল, বড় হয়ে সেনা অফিসার হবে। সে কারণে ছোটবেলা থেকে টুঙ্গিপাড়ায় শিশুদের নিয়ে প্যারেড করতো। প্যারেড করার পর তাদের পুরস্কার হিসেবে এক টাকা করে দিতো, জামা-কাপড় কিনে দিতো। শহীদ শেখ রাসেলের দেশবাসীর দোয়া কামনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ রাসেল নেই। কিন্ত এ দেশের হাজার শিশু যেন নিরাপত্তা পায়। তারা যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে। মানুষের মতো মানুষ হতে পারে। তারা যেন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়। এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার’ সুকান্তের এই উদ্ধৃতি তুলে ধরে তিনি বলেন, বিশ্বকে পারবো কিনা জানি না এ দেশকে যেন শিশুদের জন্য নিরাপদ করতে পারি, সে লক্ষ্যে কাজ করছি। আপনারা সবাই শেখ রাসেলের জন্য দোয়া করবেন।

দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আলোচনা সভায় প্রারম্ভিক বক্তৃতা করেন। আরো বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য সাবেক মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, কৃষিমন্ত্রী ড.আব্দুর রাজ্জাক, এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজীত রায় নন্দী, দপ্তর সম্পাদক ব্যরিষ্টার বিপ্লব বড়ুয়া, দলের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা মেহের আফরোজ চুমকি এবং মহানগর দক্ষিণের সভাপতি আবু আহমেদ মান্নাফি ও উত্তরের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কোচি। দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড.আব্দুস সোবহান গোলাপ এমপি গণভবন প্রান্ত থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।

জাতির পিতার কনিষ্ঠ পুত্র এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছোট ভাই শেখ রাসেল ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর ধানমন্ডির ঐতিহাসিক স্মৃতি-বিজড়িত বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মানবতার শত্রু ঘৃণ্য ঘাতকদের নির্মম বুলেট থেকে রক্ষা পাননি ১০ বছরের শিশু শেখ রাসেল। বঙ্গবন্ধুর সাথে নরপিশাচরা নির্মমভাবে তাকেও হত্যা করেছিল। তিনি তখন ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।

খবরটি 435 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen