পর্যটন ডেস্ক: পুরান ঢাকায় ভিক্টোরিয়া পার্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ভিক্টোরিয়া পার্ক পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের মাথায় অবস্থিত। পার্কটির পরিবর্তিত নাম বাহাদুর শাহ পার্ক। তবে পুরান ঢাকার বেশিরভাগ লোক ভিক্টোরিয়া পার্ক নামেই চেনে। পার্কটি ঘিরে ৬ টি রাস্তার মাথা মিলিত হয়েছে। পশ্চিম দিকে শাঁখারি বাজার, দক্ষিণ পশ্চিমে সদরঘাট, পূর্ব- দক্ষিণে নর্থ ব্রুক হল রোড, পূর্ব দিকে লক্ষ্মীবাজার, উত্তর-পূর্বে কলতাবাজার, উত্তর দিকে রায় সাহেব বাজার (স্থানীয়দের কাছে রায়শা বাজার) বা কোর্ট কাছারি। সবচেয়ে মজার একটি বিষয়, সদরঘাট যাবার জন্য যে বাসগুলো ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজনকে উঠায়, সে বাসগুলোর কোনটিই সদরঘাট যায় না। তারা মূলত যায় পুরান ঢাকার এই ভিক্টোরিয়া পার্ক পর্যন্ত। এই ভিক্টোরিয়া পার্ককেই বাসগুলো সদরঘাট বলে। বাসের চালক ও হেলপারদের কাছে ভিক্টোরিয়া পার্কই মূলত সদরঘাট।

            পাকিস্তান আমলে ভিক্টোরিয়া পার্ক: ভিক্টোরিয়া পার্ক ঘিরে আছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। ১৮৫৮ সালে ব্রিটেনের রাণী কুইন ভিক্টোরিয়ার একটি ঘোষণাপত্র এই পার্কে পাঠ করা হয়। এরপর তৎকালীন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার স্থানটির নাম ভিক্টোরিয়া পার্ক দেন। ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ বিরোধী সিপাহি আন্দোলনে ইংরেজ সেনারা বিপ্লবী সিপাহিদের এখানে ধরে এনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করত। মৃত সিপাহিদের লাশ পার্কের বিভিন্ন গাছের সঙ্গে বেধে রাখত। কারো কারো লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখতো। ইংরেজদের উদ্দেশ্য ছিল লোকজনকে ভয় দেখানো। যেসব সিপাহিদের হত্যা করা হয়েছিল তারা মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ক্ষমতায় আনার জন্য প্রাণ দিয়েছিল। এ কারণে পার্কটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। তবে সেটি বহুকাল পরে। ১৯৫৭ সালে, সিপাহী বিদ্রোহের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’ (ডিআইটি) এর উদ্যোগে এই স্থানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়।

            পার্কে খাজা হাফিজুল্লাহ’ স্মৃতি স্তম্ভ: যার নাম ‘খাজা হাফিজুল্লাহ’ স্মৃতিস্তম্ভ। খাজা হাফিজুল্লাহ ছিলেন ঢাকার নবাব স্যার খাজা আহসানুল্লাহর জ্যেষ্ঠ পুত্র। তিনি ঢাকার পরবর্তী নবাব হবে এমনটি চিন্তা করে সবাই তাকে সমীহ করতেন এবং যত্নের সাথে লালন করতেন। কিন্তু ১৮৮৪ সালে হঠাৎ হাফিজুল্লাহর অকাল মৃত্যুতে নবাব পরিবার তথা সাড়া ঢাকা শহরই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। পুত্রশোকে নবাব আহসানুল্লাহ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পুত্রশোকের কারণে ইংরেজদের বিনোদনের পৃষ্ঠপোষক নবাব আহসানুল্লাহ তাদের আমোদ ফুর্তির জন্য কোন আয়োজন করতেন না। তখন ইংরেজরা নবাবকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য এবং খাজা হাফিজুল্লাহর স্মৃতিকে জীবিত রাখতে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তার পরিচিতিমূলক একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেন। তৎকালীন ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে গ্রানাইট পাথরের তৈরি বৃহদাকার স্মৃতিস্তম্ভ জাহাজে করে আনা হয়। স্তম্ভটির চারপাশ মসৃণ এবং চক চক করে তৈরি। গোড়ার দুই দিকে পরিচিতমূলক লিপি খোদাই করা রয়েছে। ১৮৮৫ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটায় বঙ্গের ছোট লাট সাহেব এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে খাজা হাফিজুল্লাহ স্মৃতি স্তম্ভটি উদ্বোধন করেন।

            রাতের বেলা ভিক্টোরিয়া পার্ক: ভিক্টোরিয়া পার্ক ঘিরে রয়েছে বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পার্কের পশ্চিম দিকে রয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, দক্ষিণে বাংলাবাজার সরকারি স্কুল, উত্তরে কবি নজরুল সরকারি কলেজ, পূর্বে মুসলিম গভর্নমেন্ট হাই স্কুল। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শতবর্ষ পার করেছে। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রয়েছে গৌরব গাথা ইতিহাস। এলাকায় লোকজনের হাটার জায়গা খুব একটা নেই। সে কারণে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় এখানে লোক জনের সমাগম ঘটে। তবে সম্প্রতি পার্কটি সংস্কার করা হয়েছে। ভিক্টোরিয়া পার্কে বহু বৃক্ষের সমারোহ।

            নতুন সংস্কার করা পার্কে বসার স্থান: বর্তমানে পার্কে কাঁঠাল গাছ, আম গাছ, নিম গাছ, পাম গাছসহ নানা জাতের গাছ রয়েছে। কয়েকটি গাছের বয়স শত বছর পার করেছে। কিছু গাছ বিভিন্ন সময়ে বজ্রপাতে মরে গেছে। পার্কের বট গাছটি এখন নেই। এক সময় প্রচুর জবা ও মরিচা ফুলের গাছ ছিল। এখন সেগুলো নেই। ৮০ থেকে ৯০ এর দশকে এই পার্কে একটি টেলিভিশন বসানো ছিল। সন্ধ্যার পর স্থানীয় লোকজন টেলিভিশন দেখত। বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো চ্যানেল চলত না। এখন টেলিভিশনটি নেই। পার্কটির দেখভাল করে থাকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। জাতীয় দিবসগুলোতে পার্কে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এছাড়া বিভিন্ন সেবামূলক ও সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান পার্কে দেখানো হয়। বিভিন্ন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠন পার্ক এলাকায় বিশেষ কর্মসূচি পালন করে থাকে। এই পার্কে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে বর্ষ বরণ অনুষ্ঠান হয়।

            পার্কের ভেতর নতুন নির্মাণ করা পাবলিক টয়লেট: পার্কটি কয়েকবার সংস্কার করা হয়েছে। পার্কে আধুনিক টয়লেট ও গোসলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সদরঘাট যাওয়া আসার পথে পার্কটি পড়ে। এ কারণে লোকজন এই পার্কে কিছু সময় বিরাম নিয়ে যাত্রা পুনরায় শুরু করে। পার্কের নিরাপত্তা দেখভাল করে সূত্রাপুর থানা পুলিশ।

            ভিক্টোরিয়া পার্কে কীভাবে যাবেন: বাসে যেতে চাইলে গুলিস্তান থেকে কিংবা পল্টন মোড় থেকে সদরঘাটের বাসে উঠে পড়ুন পার্কেই নামিয়ে দেবে। রিকশা কিংবা উবার ভাড়া করেও ভিক্টোরিয়া পার্ক যেতে পারবেন।

            পার্ক সম্পর্কে পুরান ঢাকার এক প্রবীণ নাগরিকের সঙ্গে কথা হলো। বয়স অনুমান ৮২ বছর। তিনি বলেন, এই পার্কটি ছিল গোল। তখন কলস হাতে এক নারীর ফোয়ারা ছিল। সে ফোয়ারার পানি অনেক উপরে উঠত। যা দূর থেকে দেখা যেত। পার্ক ঘিরে ছিল গোলাপ, শেফালি, বেলি ফুলের গাছ। তবে শেফালি ফুলের গাছ বেশি ছিল। এছাড়া নিম, দেবদারু, বট গাছ ছিল। পার্কের দুই দিকে দুটি গেইট ছিল। পূর্ব দিকের গেইট দিয়ে লোকজন ঢুকে পশ্চিম দিকের গেইট দিয়ে বের হয়ে যেত।

খবরটি 678 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen