ফিচার ডেস্ক: বৎসরের প্রথম দিনে ৪ কোটির বেশী শিক্ষার্থীর হাতে নতুন বই তুলে দিল বাংলাদেশ সরকার। বিশ্ব করোনা, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এ সব বলিষ্ঠ প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করে। ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নে বিমূঢ় বাংলাদেশ সরকার ও দেশের মানুষ। বাঙালী জাতি স্বপ্ন বিলাসী জাতি। স্বপ্ন প্রাচীর যুগের পর যুগ অপেক্ষার প্রহর দিয়ে নির্মাণ করেন। যেমন স্বাধীনতার স্বপ্ন প্রাচীর এত দৃঢ়তা এবং অপেক্ষার প্রহরের শক্ত গাঁথুনি ছিল যে, দুই শত বছরে তার বিন্দু মাত্র ধৈর্য চ্যুতি ঘটাতে পারেনি। দেশ জাতি যত প্রযুক্তি নির্ভর ও ডিজিটাল হচ্ছে সামাজিক বন্ধন তত ছিড়ে যাচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে সামাজিক অবক্ষয় অন্তরাল হতে পারে।

           আমরা সামাজিক জীব। সমাজ, পরিবারের প্রতি দায়িত্ব অনস্বীকার্য। ডিজিটাল যুগের স্রোতে পলির সাথে আবর্জনা আসছে। সামাজিক অবক্ষয়ের কাছে পরাস্থ, সামাজিক মূল্যবোধ। সমাজে, শিক্ষায়, রাজনীতিতে, রাষ্ট্রে কিংবা শহর থেকে গ্রামান্তরে সামাজিক অবক্ষয়ের দৌরাত্ম্য সীমাহীন। বর্তমানে সামাজিক অবক্ষয়কে যেভাবে আমরা শ্রেণী বিন্যাস করিনা কেন। প্রকৃতপক্ষে দুই ভাগে শ্রেণীকরণ দৃশ্যতর। ডিজিটাল এবং নন ডিজিটাল। তবে দেশের মানুষের মৌলিক অধিকারের ঘাড়ে ভূতের আসর বসে আছে সামাজিক অবক্ষয়গুলো। সামাজিক অবক্ষয় রোধে রাষ্ট্র ও সমাজের ভূমিকা অতি জরুরী। সামাজিক অবক্ষয় পরিবার ও সমাজের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে। সামাজিক বন্ধনকে নষ্ট করে দেয়। প্রযুক্তির চুম্বকীয় আকর্ষণে পরিবার কিংবা সমাজ থেকে বিছিন্ন হয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তির সাথে সম্পৃক্ত মানুষগুলো। যার ফলে পরিবার, সমাজে একে অপরের প্রতি শ্রদ্বা, দায়িত্বশীলতা, কর্তব্য পরায়ণতা সচেতনা কমে যাচ্ছে। সামাজিক মূল্যবোধের শব্দগুলো, তথা ধৈর্য, উদারতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ন্যায় পরায়ণতা, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার সৌজন্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, অধ্যবসায়, নান্দনিক সৃষ্টিশীলতা, দেশপ্রেম, কল্যাণবোধ, পারস্পরিক মমতাবোধ ইত্যাদি নৈতিক গুণাবলি লোপ পাওয়ার কারণে সামাজিক অবক্ষয় দেখা দেয়। যা বর্তমান সমাজকে হুমকির মুখে ফেলে দিচ্ছে। বিশৃঙ্খল সমাজ উন্নত রুচি ও সংস্কৃতির অন্তরাল। আমরা চাই পরিকল্পিত ও সুবিন্যস্ত সমাজ ব্যবস্থা। নীতিবোধ ও চারিত্রিক মূল্যবোধ সমাজ গঠনের প্রধান শক্তি, যা আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

            আমরা করোনা কালীন সময় দেখেছি বাবা ছেলে লাশ নিতে, আমার আত্বীয় আত্বীয়দের লাশ নিতে অসম্মতি। সামাজিক অবক্ষয়ের বসতি সমাজের প্রতিটি পরতে পরতে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অবক্ষয়ের পর্যায় বলতে দেওয়ালে পিঠ ঠেকেছে। সমাজে এমন কোন অপরাধ নাই যা হচ্ছে না। অনেক অপরাধ সমাজে স্বাভাবিকতার রূপ নিয়েছে। যদি অপরাধের ধরন গতিবিধি যুগের তালে পরিবর্তিত হচ্ছে। কিশোর গেং সারা দেশে প্রযুক্তির সমীকরণে সহপাঠীকে  খুনের মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হচ্ছে। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে, ছেলে বাবাকে, ভাই ভাইকে হত্যা করে বিভিন্ন সামাজিক অবক্ষয়ের ভেলাজালে পড়ে। যৌতুক, ধর্ষণ, ইভটিজিং, নারী নির্যাতনের মতো সামাজিক অবক্ষয় গুলো সমাজে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। ধর্ষণ, যৌতুক, ইভটিজিং মতো অবক্ষয়ের ভয়াল থাবায় শুধু ভোক্তভোগীই সমাজে চরম লাঞ্ছনা নিয়ে বসবাস করেন তা নয়, ভোক্তভোগীদের পরিবারের গায়ে পাথর চাপ পড়ে যায়। বাল্য বিবাহ বর্তমানে অবাধে হচ্ছে। দায়িত্বশীল মহল নিরব। জুয়া এখন প্রযুক্তি নির্ভরশীল। বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মধ্যে জুয়া খেলা অনিয়ন্ত্রিত।

            বর্তমানে বাংলাদেশ মাদক ব্যবসার জন্য ভালো মার্কেট। নতুন মাদকে গ্রাস করে নিচ্ছে সমাজ গড়ার মানুষ গুলোকে। মাদক ও জুয়ার অর্থের জন্য ছেলে বাবার অর্থ লুট করে, তারপর পাশের বাড়িতে চুরি করে। তারপর বাবার রক্ত চোক্ষু ও সম্পত্তি বিক্রয়ে অসম্মতিতে বাবাকে হত্যা। বিভিন্ন অপসংস্কৃতি অথবা প্রযুক্তির অপব্যবহারের বিরূপ প্রভাব বর্তমান সমাজকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে সীমাহীন গতিতে। সর্বগ্রাসী সামাজিক অবক্ষয়ের কারনে সমাজ থেকে মানবিকতা, নৈতিকতা, মনুষত্ব, শ্রদ্বাবোধ কালের গর্ভে অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছে। অবক্ষয় শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে হচ্ছে তা না। সমাজপতিদের, রাজনীতিবিদদের, প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে অবক্ষয় প্রকট রূপ নিয়েছে। ঘুষ ছাড়া যেমন ফাইল চলে না, তেমনি টাকা ছাড়া সমাজপতি, রাজনীতিবিদরা চলেন না। সমাজটা অবক্ষয়ের শ্বাসরোদ্ধ গন্ধে নাভিশ্বাস নিচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে নীতি-নৈতিকার অবক্ষয় ঘটেছে চরম ভাবে। করোনা মহামারীতে আমরা স্ব্যাস্থ খাতে প্রাতিষ্ঠানিক অবক্ষয় দেখেছি। বর্তমান ঊর্ধ্ব গতির বাজারে পণ্যের দাম দ্বিগুণ করার পাশাপাশি ওজনে কমিয়েছে। আর ভেজালের ভিড়ে আসল খোঁজে পাওয়া কঠিন। অন্যভাবে যদি ভাবি। আমরা ক্রমে এক নিষ্ঠুর সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যেখানে মানবিকতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দয়া, মমতা এসব শব্দের কোনো বালাই নেই। তার জায়গা দখল করে নিয়েছে অনৈতিকতা, অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, জিঘাংসা, হিংসা, বিদ্বেষ কিংবা এ জাতীয় সব নেতিবাচক শব্দের কালো হাত। প্রতিদিনের খবরের কাগজে প্রায় উঠে আসে সামাজিক অবক্ষয়ের অধঃপতনের ভয়াল চিত্র। এ অধঃপতনের জন্য দায়ী কে? পরিবার বা সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে ব্যর্থ এ দেশের সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্র। এখন প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায় তাহলে, রাষ্ট্র ও সমাজ কেন ব্যর্থ? নৈতিক শিক্ষার প্রথম ও প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে পরিবার। পরিবারের সদস্যরা যদি নৈতিক হয় তা হলে সন্তানরা নৈতিক ও মানবিক হয়ে উঠবে।

            সামাজিক মূল্যবোধ আজ কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তা সাম্প্রতিক নানা অপরাধমূলক ঘটনার দ্বারা প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত হয়। যারা সমাজকে, রাষ্ট্রকে প্রতিনিয়ত দূষিত করছে। সমাজ ও রাষ্ট্রকে ভারসাম্যহীন করে তুলার জন্য যারা দায়ী, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। রাজনৈতিক আদর্শ চ্যুতি, জন বিমুখী চিন্তাচেতনা রাজনীতির নীতিকে গ্রাস করেছে।দেশের রাজনৈতিক দল গুলোতে গণতন্ত্র এবং সাংগঠনিক শব্দ গুলো শুধু শাব্দিক অর্থে আছে। অবৈধ অর্থ, ক্ষমতা ও দলীয় করণের দাপট দেখিয়ে সমাজে সব ধরনের অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে রাজনীতিবিদরা। যা সমাজে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলছে। সমাজে সুস্থ গতিপ্রবাহ বা পুননির্মাণের দায়িত্ব কার? রাষ্ট্র, সমাজ না সচেতন নাগরিকের? এ সহজ প্রশ্নের জটিল সমীকরণ নিউত্তর। সমাজে নানা শ্রেণীপেশা ও বিচিত্র লোক, তাদের চিন্তাভাবনা ও রুচি অভিন্ন। তাদেরকে একই ছাউনিতে আনা জটিল। সামাজিক ভারসাম্য রক্ষায় অবক্ষয় রোধের বিকল্প নাই। সমাজের নানান ধরনের সামাজিক অবক্ষয়কে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে হবে। সমাজ, পরিবার, ব্যক্তি একে অপরের পরিপূরক। সমাজ রক্ষা করতে না পারলে পরিবার, ব্যক্তিকে রক্ষা করা কঠিন হবে। লেখক ও কলামিস্ট, নান্দাইল, ময়মনসিংহ।

খবরটি 405 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen