স্টাফ রিপোর্টার, বান্দরবান: বান্দরবানের ম্রো আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪২ তম বর্ষপূর্তি উদযাপন করা হয়। শুক্রবার (২৫ নভেম্বর) সকালে সুয়ালক ম্রো আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের বর্ষপূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। এ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন করেন পার্বত্যমন্ত্রী। বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ ২ কোটি ৭৯ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন করবে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড।

            এ সময় বিশেষ অতিথি উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা, জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি, পুলিশ সুপার মো: তারিকুল ইসলাম, পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য ক্যসা প্রু, সিং ইয়ং ম্রো, লক্ষীপদ দাশ, সিয়ং খুমি। অন্যান্যদের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের বান্দরবান ইউনিটের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু বিন মো: ইয়াছির আরাফাত, বান্দরবান প্রেসক্লাবের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বাচ্চু, সাধারণ সম্পাদক মিনারুল হক, ম্রো আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো: মহিন উদ্দিন, ম্রো আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ও বর্তমান অধ্যায়নরত শিক্ষার্থী অভিভাবকরা উপস্থিত ছিলেন।

            ম্রো আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়। ৪২ তম বর্ষপূর্তিতে প্রাক্তন ছাত্র ছাত্রীদের পূনর্মিলনী। অনগ্রসর ম্রো ও খুমি জনগোষ্ঠীর শিক্ষার উন্নয়নের জন্য বিদ্যালয়টি ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। একই বছরের ২০ জানুয়ারি প্রাতিষ্ঠানিক কাজ পাঠদান শুরু হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড সহায়তায় ও শিক্ষানুরাগী হেডম্যান ইয়ামতুই ম্রো প্রচেষ্টায় সুয়ালক এলাকায় ম্রো আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে। তখন থেকে দুই জনগোষ্ঠীর শিক্ষিত প্রজন্মের জন্মের শুরু। এর আগে তাদের শিক্ষার হার শূন্য ছিল। প্রতিষ্ঠিতার পর থেকে এ প্রতিষ্ঠান থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১,৫৪৮ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। এখান থেকে এসএসসি শেষ করে বিভিন্ন কলেজে এ পর্যন্ত ২৯৪ জন এইচএসসি উত্তীর্ণ হয়েছে। বর্তমানে ম্রো ও খুমি জনগোষ্ঠী মিলে ৫৫ জন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে।

            এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও জেলা পরিষদ সদস্য সিং ইয়ং ম্রো জানান, এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে দুই জনগোষ্ঠীর Ethnographic History কে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার আগের ও পরের ইতিহাস। প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার আগের ম্রো ও খুমি জনগোষ্ঠী ছিল প্রকৃতির কাছে লব্দ জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল ও নিজেদের গণ্ডির মধ্যে জীবন যাপনে অভ্যস্ত। বাইরের জগতের সঙ্গে তাদের খুব একটা যোগাযোগ ছিল না। আধুনিক শিক্ষা সম্পর্কে তাদের ধারণা পরিস্কার ছিল না। সমাজের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করতেন, স্কুল কলেজে পড়াশোনা করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলে নিজেদের সমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য থেকে দুরে সরে যাবে। এর ফলে তাদের জনগোষ্ঠীর বিলুপ্তি হবে। এ ধারণা যুগ যুগ ধরে ম্রো ও খুমিদের শিক্ষা বিমুখ করে রাখে।

            তিনি আরও জানান, ম্রো আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে শিক্ষার প্রতি নেতিবাচক রক্ষণশীলতা পরিবর্তন হতে থাকে। বিদ্যালয়ের শুরুতে শিক্ষার্থী পাওয়া কঠিন হয়ে দাড়িয়েছিল। অভিভাবকরা ছেলে মেয়ে দিতে রাজি হত না। বিভিন্ন প্রলোভনে, কোথাও ভয়ভীতি দেখিয়ে ছেলেমেয়ে যোগার করতে হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানের একটি ব্যতিক্রম উদাহরণ রয়েছে একজন কিশোর ভর্তির জন্য প্রচণ্ড আগ্রহী। যদিও তার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির বয়স অতিক্রান্ত হয়েছে। বাবা-মায়ের বাধা ও বয়স বেশি হওয়ায় ভর্তি করতে শিক্ষকদের অনাগ্রহ সত্বেও কিশোর নাছোরবান্ধা। ভর্তি হতে হবে। তিনি হলেন ম্রো জনগোষ্ঠীর ক্রামা ধর্মের প্রবর্তক ও ক্রামাদি মেনলে ম্রো। এ প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে তরুণ বয়সে পরিণত মেনলে ম্রো ক্রামা ধর্মের প্রবর্তন ও ম্রো বর্ণমালার উদ্ভাবন করে প্রতিষ্ঠানটির অবদানকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি নিজের প্রবর্তিত ধর্ম সমাজে প্রচার করেছেন। উদ্ভাবিত বর্ণমালা ম্রো জনগোষ্ঠীর মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন। একই সঙ্গে শিক্ষার প্রতি কুসংস্কার বা ভূল ধারণা ভেঙেছেন। নানা বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে তিনি উপলব্দি করাতে সক্ষম হয়েছেন একটি জনগোষ্ঠীর সামাজিক সাংস্কৃতিক উন্নয়নে শিক্ষার বিকল্প নেই। ম্রো সমাজের সংস্কারক মেনলে ম্রো সমাজের সবক্ষেত্রে ক্রামা ধর্ম, ম্রো বর্ণমালা ও শিক্ষার বার্তা পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছেন। ম্রো সমাজে তিনি ক্রামাদি অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার প্রেরিত পুরুষ হিসেবে পরিচিত। তার নীরব সংস্কার আন্দোলনের কারণে ম্রো আবাসিক উচ্চ বিদ্যালয়ে ছেলেমেয়ে ভর্তির হিড়িক পড়ে যায়। একজনের ভর্তির আসনে ১০-১২ জনের প্রতিযোগী হয়ে দাড়ায়।

খবরটি 461 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen