অর্থনীতি ডেস্ক: করোনা মহামারী ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ঋণ পরিশোধে বড় ছাড় দেয়া হয়েছে। ঋণ নিয়মিত পরিশোধ না করলেও এখন খেলাপী করা হচ্ছে না। কিস্তি পরিশোধও অনেক শিথিল করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও ঋণ শ্রেণীকরণের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করছে না। এত ছাড়ের মধ্যে গত জুন পর্যন্ত খেলাপী ঋণ বেড়ে সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তবে ব্যাংক থেকে বার বার তাগিদ দেয়ার পরও কিস্তি পরিশোধ না করায় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপীর বিরুদ্ধে এবার কঠোর অবস্থান নিয়েছে ব্যাংকগুলো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি তৎপর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। গত দুই মাসে জনতা ও রূপালী ব্যাংকের দায়ের করা বিভিন্ন মামলায় বড় বড় ঋণ খেলাপী কয়েকজন গ্রাহককে আটক করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থঋণ আদালতে অনেক মামলা হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত রাখা হচ্ছে। এছাড়া চাহিদার তুলনায় দেশে অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা কম। আদালতগুলোর বিচারক সংখ্যাও যথেষ্ট নয়। এসব কারণে অর্থঋণ আদালতে মামলাজট তৈরি হচ্ছে।

            জানা গেছে, ৫০০ কোটি টাকার বড় অঙ্কের একটি মেয়াদী ঋণ চার দফায় ২৯ বছরের জন্য পুনর্তফসিলের সুযোগ দিয়ে গত ১৮ জুলাই সার্কুলার জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ১৬ দিনের মধ্যে সংশোধনী দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেয়া নতুন সার্কুলারে ঋণখেলাপীদের আরও ছাড় দেয়ার পাশাপাশি বেশ কিছু ক্ষেত্রে কড়াকড়িও করা হয়। এতে বলা হয়, পুনর্তফসিল করা কোন ঋণ ৬ মাস অনাদায়ী থাকলে তা সরাসরি ক্ষতিজনক মানে শ্রেণীকরণ করতে হবে। আর প্রকৃত আদায় ছাড়া পুনর্তফসিল করা ঋণের সুদ আয় খাতে নেয়া যাবে না। সব ক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনের বাধ্যবাধকতার শর্ত তুলে দেয়া হয়েছে। এছাড়া পুনর্তফসিল করা কোন ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে খেলাপী করলে সেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।

            বাংলাদেশ ব্যাংকের খেলাপী ঋণ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপী ঋণ ছিল ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকা। গত জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। আলোচ্য ছয় মাসে খেলাপী ঋণ বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত খেলাপী ঋণ বেড়েছিল ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। গত মার্চ প্রান্তিকে খেলাপী ঋণ ছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা। মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বেড়েছে আরও ১১ হাজার ৮১৮ কোটি টাকা। ওই ছয় মাসে বেড়েছে ২২ হাজার কোটি টাকা। গত বছরের জুনে খেলাপী ঋণ ছিল ৯৯ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। এক বছরে অর্থাৎ গত বছরের জুনের তুলনায় গত জুনে খেলাপী ঋণ বেড়েছে ২৬ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। এর আগেও একবার খেলাপী ঋণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে ছিল। পরে তা আবার কমে আসে। কিন্তু কখনই সোয়া লাখ কোটি টাকা ছাড়ায়নি। এবারই প্রথম খেলাপী ঋণ সোয়া লাখ কোটি ছাড়াল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন মাস শেষে ব্যাংকিং খাতের মোট বিতরণ করা ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপীতে পরিণত হয়েছে এক লাখ ২৫ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৮ দশমিক ৯৬ শতাংশ। যা এ যাবতকালের এটাই সর্বোচ্চ খেলাপী ঋণের অঙ্ক। অর্থনীতিবিদ ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন ব্যাংকগুলোকে ঋণ পুনর্তফসিল করার ক্ষেত্রে যৌক্তিক হতে হবে। শুধু প্রকৃত অর্থেই কোন কারণে খেলাপী হয়ে গেছে, তাদের ঋণ পুনর্তফসিল করতে হবে। আর স্বভাবজাতদের কোন সুবিধা দিয়ে লাভ নেই। মামলার হালনাগাদ তথ্যসংবলিত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সাধারণত যেসব খেলাপী ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা কম থাকে, সেগুলো আদায়ের জন্যই ব্যাংকগুলো আদালতে মামলা করে থাকে। এগুলো হচ্ছে অর্থঋণ মামলা, সার্টিফিকেট মামলা এবং দেউলিয়া ও অন্যান্য মামলা। প্রতিবেদন অনুযায়ী সার্টিফিকেট মামলার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি, ১ লাখ ৫২ হাজার ৬২৬টি।

            আবার এই সার্টিফিকেট মামলায় জড়িত টাকার পরিমাণ সবচেয়ে কম, ২ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা। অর্থঋণ আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৬০ হাজার ৯৭৩টি। এসব মামলার বিপরীতে জড়িত রয়েছে ১ লাখ ২৯ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। রিট মামলা আছে ৫ হাজারটি, যেগুলোতে জড়িত টাকার পরিমাণ ৩৪ হাজার ৭৮৮ কোটি। এ ছাড়া দেউলিয়া ও অন্যান্য মামলা রয়েছে ৫৮ হাজার ৪৯৫টি, এসব মামলার বিপরীতে জড়িত অর্থের পরিমাণ ৮৪ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। এ বিষয়ে কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব-উল-আলম বলেন, হাইকোর্টের আদেশের মাধ্যমে অর্থঋণ আদালতের মামলা বছরের পর বছর আটকে আছে। এছাড়া চলমান মামলার বিচারকাজ অযৌক্তিকভাবে মুলতবি রাখা হয়। বিচারকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় এসব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, হাইকোর্টের আদেশে যে মামলাগুলো স্থগিত রয়েছে, সেগুলো বাতিলের ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এজন্য উদ্যোগ নিতে হবে। স্থগিত মামলাগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতির কাছে দিতে হবে। আইন মন্ত্রণালয় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলাপ করে এসব স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে। এছাড়াও অর্থঋণ আদালত ও বিচারক বৃদ্ধি এবং দক্ষ বিচারক দিয়ে এসব মামলার বিচার পরিচালনার ব্যবস্থা করতে হবে বলে মন্তব্য করেন ব্যারিস্টার তানজীব-উল-আলম। ব্যাংক থেকে বার বার তাগিদ দেয়ার পরও কিস্তি পরিশোধ না করায় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপীর বিরুদ্ধে এবার কঠোর অবস্থান নিয়েছে ব্যাংকগুলো। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকের অর্থঋণ ও সার্টিফিকেট মামলায় বড় বড় ঋণখেলাপী গ্রাহককেও গ্রেফতার করা হয়েছে। ৩২৫ কোটি ৮৪ লাখ টাকা পরিশোধ না করে আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় নূরজাহান গ্রুপের এমডি জহির আহমেদ রতন, পরিচালক টিপু সুলতান ও ফরহাদ মনোয়ারকে ৫ মাসের কারাদ- দেন অর্থঋণ আদালত। পাশাপাশি রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের (আরএসআরএম) এমডি মাকসুদুর রহমানকে ৩১২ কোটি ৮২ লাখ টাকা ঋণখেলাপীর দায়ে পাসপোর্ট জব্দসহ দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত। এছাড়া মতিঝিল কর্পোরেট শাখায় গোল্ডেন রি- রোলিং মিলস লিমিটেডের সাড়ে ৬ কোটি টাকা অনাদায়ে খেলাপী গ্রাহক মোঃ আবুল হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। বৈদেশিক বাণিজ্য কর্পোরেট শাখার আব্দুস সামাদ প্যাকেজিংয়ের আড়াই কোটি টাকা অনাদায়ে প্রতিষ্ঠানটির ৩ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়।

            গাজীপুর কর্পোরেট শাখার খেলাপী গ্রাহক মেসার্স হাসান স মিলের ১ কোটি ১ লাখ টাকা অনাদায়ে মিলটির মালিক খন্দকার জাকির হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়। জানতে চাইলে জনতা ব্যাংক লিমিটেডের এমডি ও সিইও বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আব্দুছ ছালাম আজাদ বলেন, খেলাপী ঋণ কমিয়ে আনার বিষয়ে আমরা আন্তরিক। এজন্য যেসব খেলাপী গ্রাহক দীর্ঘ সময় ধরে ঋণ পরিশোধে সময়ক্ষেপণ করছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনী তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে। এদিকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের চার ঋণখেলাপীকে গত মাসে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে এনডি গ্রুপের চেয়ারম্যান মাহমুদা জামানও রয়েছেন। গ্রেফতার হওয়া অন্য আসামিরা হলেন মোঃ আলমগীর হোসেন, মাহবুব আলম ও এইচএম শহীদুল আলম মানিক। তারা সবাই এনডি গ্রুপের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে রূপালী ব্যাংক সূত্রে জানা গিয়েছে। আটকের পর আদালত তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, রূপালী ব্যাংকের কাওরানবাজার টিসিবি ভবন কর্পোরেট শাখার গ্রাহক এনডি গ্রুপের কাছে ৪৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকার ঋণ দীর্ঘদিন ধরে অনাদায়ী। ব্যাংকের পক্ষ থেকে বারবার যোগাযোগ করা হলেও গ্রাহকরা কোন সাড়া দিচ্ছিলেন না। পরে অর্থঋণ আদালতে এনডি গ্রুপের চেয়ারম্যান, এমডিসহ ঋণের জামিনদারদের বিরুদ্ধে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ মামলা দায়ের করেন। আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করায় পুলিশ চার আসামিকে গ্রেফতার করেছে। এ বিষয়ে রূপালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ে আমরা কঠোর অবস্থান নিয়েছি। এনডি গ্রুপের চেয়ারম্যানসহ চার আসামিকে গ্রেফতারের মাধ্যমে খেলাপীদের কাছে একটি বার্তা যাবে। ব্যাংকের অন্য ঋণখেলাপীদের বিরুদ্ধেও আইনী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। খেলাপী ঋণ কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে আমরা কোন আপোস করব না।

            ঋণ আদায়ে আড়াই হাজার কোটি টাকা সুদ মওকুফ: সরকারী ব্যাংকের চেয়ে বেসরকারী ব্যাংকগুলোতে সুদ মওকুফের ঘটনা বেশি ঘটছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকে জুন-এই তিন মাসে বেসরকারী ব্যাংকগুলো তাদের বিতরণ করা ঋণে সুদ মওকুফ করেছে ২ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা। যা আগের প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ছিল মাত্র ১৯১ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো আগের প্রান্তিকের তুলনায় ২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা বেশি সুদ মওকুফ করেছে, যা প্রায় ১২ গুণ বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে এই তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে সুদ মওকুফ পাওয়া গ্রাহকদের নাম উল্লেখ করা হয়নি, তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সুদ মওকুফের সিংহভাগ সুবিধা নিয়েছেন ব্যাংকের পরিচালকরা। কিছু ক্ষেত্রে বেসরকারী ব্যাংকগুলো এখন অন্যান্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে মিলেমিশে যোগসাজশের মাধ্যমেও সুদ মওকুফ করছে।

            অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সবসময় বড় ঋণখেলাপীরা বেশি সুদ মওকুফ সুবিধা পান। ক্ষুদ্র ও মাঝারি গ্রাহকরা এই সুবিধা থেকে অনেক দূরে থাকেন। এই প্রক্রিয়ার একটি বড় কুফল হচ্ছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপীর পরিমাণ বাড়ে। প্রসঙ্গত, ব্যাংকের পরিচালক, পরিবারের সদস্য বা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সুদ মওকুফে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদনের যে বাধ্যবাধকতা দেয়া ছিল, গত ২৪ মে তা তুলে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এই শর্ত শিথিলের পর ব্যাংক ও পরিচালকরা কৌশলে নিজেদের ঋণের সুদ মওকুফ করে নিচ্ছেন। যদিও এই শর্ত শিথিলের আগেও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি সাপেক্ষে দেশের শীর্ষ দুই ব্যবসায়ী গ্রুপ একে অপরের ব্যাংক থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার সুদ মওকুফ সুবিধা নেয়। অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা অনাদায়ী ঋণের আসল টাকা আদায় করতে গিয়ে সুদ মওকুফের কৌশল নিচ্ছে ব্যাংকগুলো। তবে কিছু ক্ষেত্রে বেসরকারী ব্যাংকগুলো এখন অন্য ব্যাংকের পরিচালকদের সঙ্গে মিলে যোগসাজশের মাধ্যমেও সুদ মওকুফ করছে।

খবরটি 371 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen