পর্যটন ডেস্ক: ধুলা উড়িয়ে পাথরকুচি ছিটকিয়ে ছোটে এসইউভি। আগ্নেয়গিরির উড়ে আসা ছাইয়ের কারণে কাঁচা সড়কটির রং কালচে। নুড়িপাথরগুলো মরচে বর্ণের। ক্যাটল র‌্যাঞ্চের মালিক সিনিওর হেরনানদেজ অত্যন্ত বিত্তবান, নানা রকমের ছোটখাটো ব্যবসায়ে খাটছে তাঁর পুঁজি। তার গেস্টহাউসে আছে ভাড়া দেওয়ার জন্য কতগুলো মাউন্টেন বাইক। চাইলে তরুণ বয়সী পর্যটকরা ওখান থেকে রাবারের ডিঙি নৌকা বা সার্ফিং বোর্ড ইত্যাদি ভাড়া করতে পারে। দিগন্তের কাছাকাছি সরোবরের জলে রোদের তীব্র কিরণে ছড়াচ্ছে বেগুনি মেশা রুপালি আভা। তার ঠিক মাঝখান থেকে আকাশ পানে মাথা তুলছে একটি নয়, দুটি আগুন পাহাড়। এতক্ষণ পর্যন্ত আমি মমোতমবো নামের পিরমিডিক্যাল শেপের একটি পাহাড়। কাছাকাছি দুটি ছোট বড় আগ্নেয়গিরিকে জোড় বেঁধে একত্রে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্রেফ তাজ্জব! এই প্রেক্ষাপট থেকে পাহাড় দুটির শেপকে দেখায় খানিকটা গোলাকার বেজায় প্রাকৃতিক স্ট্রাকচারের মতো। সুদীর্ঘ পাহাড়টি মমোতমবো সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা চার হাজার ২৫৫ ফুট, তুলনামূলকভাবে খাটো পাহাড়টির নাম মমোতমবিতো তার শৃঙ্গ দুই হাজার ৭৮৬ ফুট ওপরে। যত সহজে মমোতমবোর চূড়ায় হাইকাররা পৌঁছতে পারে, মমোতমবিতোর চূড়ার পথটি অতটা সুগম নয়। সরোবর লেক মানাগুয়ায় যুগল আগুন পাহাড়ের অবস্থান। আগ্নেয়গিরি দুটিকে ফের ত্রিভুজাকৃতির পিরামিডের মতো দেখায়।

            আর্কিওলজিক্যাল সাইটের পর্যটন আপিস থেকে নিতে হবে টিকিট। সঙ্গে পাওয়া যায় পুরাকালের প্রাকৃতিকভাবে সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়া জনমানুষহীন বিরান এক নগরীর ইতিবৃত্ত সংবলিত ব্রশিয়ার। আপিস থেকে কিছু পর্যটক সামান্য পয়সার বিনিময়ে ট্যুর গাইড ভাড়া করা হয়। নিকারাগুয়ার সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের নজরে পড়ে পঞ্চদশ শতাব্দীর পয়লা দিকে। ক্রিস্টোফার কলম্বাস তার চতুর্থ অভিযাত্রায় পাশের দেশ হন্ডুরাস থেকে সৈন্য সামন্ত ও যুদ্ধজাহাজ নিয়ে হামলে পড়েন নিকারাগুয়ার সমুদ্রতটে ১৫০২ সালে। সে আমলে এ এলাকায় বাস করত আমেরিকা মহাদেশের আদিবাসী (ভুলবশত রেড ইন্ডিয়ান নামে কোনো ক্ষেত্রে পরিচিত) চরোতেগা, নিকারাও, সাবাতিয়াবা প্রভৃতি গোত্র। কলম্বাসের স্প্যানিশ আক্রমণ এসব আদিবাসী সম্প্রদায় সাহসের সঙ্গে প্রতিহত করে। যুদ্ধে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির কারণে টিকতে না পেরে কলম্বাস পিছু হটেন।

             ১৫২২ সালে ফ্রানসিসকো করডোবার নেতৃত্বে স্প্যানিয়ার্ডরা ফের হামলা চালালে যুদ্ধক্ষেত্রে সে যুগের নিরিখে আধুনিক সমরাস্ত্রের আধিপত্যের কারণে আদিবাসীরা মারাত্মকভাবে পরাস্ত হয়। দেশটি সফলভাবে বিজিত করার জন্য করডোবাকে এসপানিওলে কনকিসাতাডোর বলা হয়। করডোবাই ঠিক এই জায়গায় (বর্তমানে যা লেওন ভিয়েখো নামে পরিচিত) স্থাপন করেছিলেন স্প্যানিশ উপনিবেশের রাজধানী। সে আমলে এ এলাকায় গ্রামগুলোতে বাস ছিল প্রায় পনেরো হাজার আদিবাসীর। করডোবার ঔপনিবেশিক আমলা পেয়ালারা আদিবাসীদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে তাদের নিয়োজিত করে খনিতে স্বর্ণ ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু আহরণে। তাদের সংসারের সোমত্ত মেয়েদের ছিনতাই করে কোনো ক্ষেত্রে ভিন্ন দেশের দাস বাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়। কোনো ক্ষেত্রে জাহাজ ভাসিয়ে এ দেশে আসা নাবিক ও প্রশাসকরা তাদের গৃহে আদিবাসী তরুণীদের রাখনি হিসেবে রাখত। ফলত হালজামানায় নিকারাগুয়েনসে নামের বাদামি গাত্রবর্ণের এসপানিওলে কথা বলে যে মূলধারার মানুষজন নিকারাগুয়া শাসন করছে তারা আদতে স্প্যানিশ কনকিসতাডোর বা পুরুষ অভিযাত্রী ও নিকারাগুয়ার লুণ্ঠিত আদিবাসী নারীদের বংশধর।

            মিশ্রিত এই জাতিসত্তা স্থানীয়ভাবে ‘মাস্তিসো’ নামে পরিচিত। এ দেশে এখনো বসবাস করছে বেশ কিছু আদিবাসী গোত্র। স্বর্ণ বেচাকেনার আড়ং হিসেবে লেওন ভিয়েখো পরিণত হয়েছিল সে জামানার এক জমজমাট নগরীতে। ঔপনিবেশিক এই শহরের তমতমি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ষোল শতকের পয়লা দিকে মমোতমবোর অগ্ন্যুৎপাতের ফলে এ এলাকা ভূমিকম্পের কবলে পড়ে। প্রথম কয়েক বছর স্প্যানিশ প্রশাসকরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না কী করবেন। তবে ১৬১০ সালে ভূমিকম্পে লেওন ভিয়েখোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হলে অবশেষে নগরী এখান থেকে সরিয়ে বিশ মাইল দূরে বর্তমানে যেখানে লেওন নগরী অবস্থিত ওখানে রিলকেট করা হয়। বর্তমানের লেওন নগরীটি আদতে এই পুরাতাত্ত্বিক নগরীর স্থানান্তরিত বিকাশ। পাথরের গাঁথুনিতে কোথাও বর্গক্ষেত্র আবার কোথাও লম্বাকৃতির স্ট্রাকচারগুলোর ভিত পড়ে আছে। দু-চারজন পর্যটক ঘুরেফিরে ছবি তুলছে। এই ভিতগুলো দেখে আন্দাজ করা কঠিন, ঠিক এই জায়গায় চার শ বছর আগে পরিশোধিত হতো নানা রকমের ধাতু। জড়ো হতো সুবর্ণ বণিকরা, দিনভর চলত বেচাকেনা। একটি অট্টালিকায় নিলামে বিক্রি হতো লুট করে আনা আদিবাসী কুমারীদের। গির্জা, কারাগার, খাজনার তহশিল ও রঙ্গশালার পাথুরে কাঠামো। কিছু স্ট্রাকচার ঘিরে হালকা ঝোপঝাড়। এদিকে ডালপালা ছড়ানো গাছপালা প্রচুর। দেখা যায় ডালে বা পাতার আড়ালে বসে থাকা পাখিদের ছবি। দিস প্লেস ইজ আ রিয়াল প্যারাডাইজ অব বার্ডস। হোয়াট ডু ইউ নো আবাউট বার্ডস অব নিকারাগুয়া। এ দেশে মোট ৭৮১ প্রজাতির পাখি বসবাস করে। এ ছাড়া অতিথি পাখি তো আছে। বেশ কিছু বিরল প্রজাতির পাখির তালাশ কেবল নিকারাগুয়াতে পাওয়া যায়। ঝলমল করে ওঠে গোয়ারদাবারনকো নামের দারুণ রকমের বর্ণাঢ্য পাখির উপস্থিতি। নাট্যমঞ্চে লোকপ্রিয় নায়িকার মতো নিকারাগুয়ান সংস্কৃতিতে এই পাখির স্টার স্ট্যাটাস আছে। জাতীয় পাখি হিসেবে মর্যাদাবান এই খেচরটির ছবি ক্যালেন্ডার ও বিলবোর্ডে সর্বত্র আকসার দেখা যায়। পরের ফ্রেমে চাচালাকা বলে আরেকটি ইন্টারেস্টিং পাখির আলোকচিত্র দেখতে পাই। ঝোপের তলা দিয়ে কালো পালকের বড়সড় একটি হাঁস হেঁটে এলে ‘অহ মাই সুইট লর্ড, দিস ইজ কোরাসো দিস বার্ড ইজ সো রেয়ার, এরা ওড়ে কম, ঝোপের নিচে হেঁটে পোকা মাকড় ধরতে ভালোবাসে। কোরাসো নামের বৃহৎ খেচরটি তার হলুদ ঠোঁট বাঁকিয়ে থেমে যেন পোজ দেয়। পেছন আসে লাকি চার্ম বা কবজিতে জড়ানোর ছোট্ট ছোট্ট মালা নিয়ে এক আদিবাসী মহিলা। সে বিডের মালাগুলো ঝনঝনিয়ে নাকি সুরে আওয়াজ দেয়, ‘আমুলেটো দেলা সুয়ার্তে, মুই বারাতো’ বা ‘কবজিতে জড়ানোর সৌভাগ্য সূচক চার্ম, খুব সস্তা। ঘুরে তাকাতে চাঁদের মতো গোলগাল মুখের মহিলা করুণভাব ‘কম্প্রে পর ফাভর’ বা ‘প্লিজ একটি লাকি চার্ম।

            ধ্বংসস্তূপে একটি পাথুরে ভিতের কাঠামোতে দর্জির ফিতা দিয়ে মাপজোখ করে নোট নিচ্ছেন হ্যাট মাথায় শুভ্রশ্মশ্রু এক বৃদ্ধ, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী। অধ্যাপক টমাসের এক্সপার্টিজ বিগত জামানায় ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরসমূহের পুরাতত্ত্বে। অধ্যাপক শ্যারোলের আগ্রহ মৃৎপাত্রের গায়ে আঁকা চিত্র ও প্রতীকের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ। লেওন ভিয়েখো নগরীটি পুরো তিন শতাব্দী ছিল আগ্নেয়গিরির ছাই ও লাভাস্তরের নিচে লুকানো। ১৯৬৭ সালে যখন আর্কিওলজিস্টরা নগরীর এই ধ্বংসস্তূপ খুঁড়ে বের করেন, তত দিনে লেওন ভিয়েখোর সঠিক অবস্থান মানুষজনের স্মৃতি থেকে মুছে যেতে বসেছে। অধ্যাপক টমাস ফ্যালাচি ডক্টরাল স্টুডেন্ট হিসেবে তাঁর অ্যাডভাইজার এক অধ্যাপকের তত্ত্বাবধানে এখানকার খোঁড়াখুঁড়িতে অংশ নিয়েছিলেন। তখন থেকে তাঁর ইচ্ছা লেওন ভিয়েখো নিয়ে লিখবেন একটি গবেষণা ভিত্তিক প্রবন্ধ। তারপর নিকারাগুয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হলে আমেরিকার একাডেমিক গবেষকদের এদিকে আসা দুরূহ হয়ে পড়েছিল। এখন অবশ্য যাতায়াতে কোনো সমস্যা নেই, তিনি অবসর নিয়ে হাতে পেয়েছেন প্রচুর সময়। তাই তাঁরা দুজনই এসেছেন মাঠ পর্যায়ে সরেজমিনে ডাটা কালেক্ট করতে। ইচ্ছা যে প্রবন্ধটি এত বছর লেখা হয়ে ওঠেনি সেটি তৈরি করে ফেলা। ‘কায়ে রয়াল’ নামের একটি সরণিতে। যেসব আদিবাসী মানুষ ঔপনিবেশিক প্রশাসকদের হুকুম আমান্য করত বা যারা খনিতে শ্রম দিতে অস্বীকার করত, তাদের হাতকড়া পরিয়ে এই কায়ে রয়াল ধরে নিয়ে যাওয়া হতো সরণির শেষ প্রান্তে ‘প্লাজা মায়োর’ বা মেইন স্কয়ারে। ওখানে ওদের ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে বা শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হতো।

            এখানে আদিবাসী বিদ্রোহী এক পুরুষের মূর্তি অবাক করে। এ স্ট্যাচুটির নাম ‘মনুমেনতো আলা রেজিসটেনসিয়া’ বা ‘প্রতিরোধের মিনার। আদিবাসী মহিলা ওখানে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা করছেন। যদিও সফল হয়নি, নিকারাগুয়ার আদিবাসী মানুষজন বারবার ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিবাদ করেছে। তারা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে স্পানিয়ার্ড সৈনিকরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর লেলিয়ে দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করত। স্পেন থেকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে কলম্বাসের সাঙ্গোপাঙ্গরা এই এলাকায় আসার আগে আদিবাসীরা কখনো কুকুর বা ঘোড়া দেখেনি। প্রতিবাদরত আদিবাসীরা দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় পরাস্ত হতো স্প্যানিয়ার্ড ঘোড়সওয়ার সৈনিকদের গতির কাছে। আর হিংস্র কুকুরগুলো ছড়াত দারুণ সন্ত্রাস। তার পর তারা প্রতিবাদ বহাল রেখেছিল যুগ যুগ ধরে। আদিবাসী মহিলা একমুঠো ধুলোমাটি তুলে তা দিয়ে লেপে দেন কুকুরটির চোখ মুখ। ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরীর এক প্রান্তে। পাশাপাশি দুটি সমাধির কাছে দাঁড়িয়ে ফলক পড়ে জানা যায়, একটি কবরে গোর হয়েছিল কনকিসতাডোর ফ্রানসিসকো করডোবার। পাশে সমাহিত হয়েছিলেন স্প্যানিশ উপনিবেশের গভর্নর পেডরাসিয়াস ডাবিলা। শেষ বয়সে ক্ষমতার গজদন্ত মিনার থেকে পতন হয়েছিল করডোবার। তাকে হটিয়ে দিয়ে শাসনদণ্ড হাতে নিয়েছিলেন পেডরিয়াস ডাবিলা। তিনি করডোবাকে মেইন স্কয়ারে শিরশ্ছেদ করেছিলেন। যে কবরে করডোবার মস্তকহীন দেহটি সমাহিত হয়েছে, পরবর্তী যুগে গভর্নর ডাবিলাকে তার পাশে অন্য একটি কবরে গোর দেওয়া হয়। তাদের জোড়া কবরের পাশে দাঁড়িয়ে সেই আমলের লেওন ভিয়েখো নগরীর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে পড়েছে তিন চারজন আদিবাসী ফেরিওয়ালা। তারা স্রেফ তামাশা দেখছে। খানিক হেঁটে আসতেই দেখি, সরোবরের কিনারজুড়ে ফুটে আছে নানা বর্ণের অজস্র সন্ধ্যামালতি। এই ফুলগুলো নিকারাগুয়ায় ‘মিরাবিলিস জালাপা’ নামে পরিচিত। যেখানে সরোবরটির কিনারা বেঁকে গেছে সারসের গ্রীবার মতো, ওখানে ড্রামে চাটি মারতে মারতে এসে দাঁড়িয়েছে চারজন আদিবাসী মানুষ। এদের দুজনের হাতে কাটা বাঁশের টুকরার মতো কাপড়ের ন্যাতাকিনি পেঁচানো বিচিত্র কোনো বাদ্যযন্ত্র। বাদ্য বাজনার তালে তারা আগুন পাহাড় মমোতমবোর উদ্দেশে জানাচ্ছে তাদের অন্তরের আকুতি।

খবরটি 483 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen