ফিচার ডেস্ক: ১৯৭০ সালের নির্বাচন বাঙালি জাতির ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হার-জিতের ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করছিল সাত কোটি বাঙালির ভাগ্য। দুই যুগের মতো সময় ধরে আওয়ামী লীগের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যেভাবে পুরো জাতিকে একাট্টা করেছিলেন স্বাধীনতার জন্য, তার ফলাফল দেখার মহেন্দ্রক্ষণ ছিল এটি। আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে হাজার বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলার জন্য জাতি যখন প্রস্তুত, ঠিক এমন সময় নেমে এলো দুর্যোগের ঘনঘাটা। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে কেঁপে ওঠে বাংলার দক্ষিণাঞ্চল। মানুষের মৃত্যুকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানি জান্তারা যখন ইলেশকশান ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যস্ত, এমন পরিস্থিতিতেও প্রচার-প্রচারণা বাদ দিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির লাশ মাড়িয়ে সামনে এগুনোর নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি সবসময়। ক্ষমতা, অর্থ কোনোকিছুর মোহেই তিনি তার মানবিক গুণাবলীর সঙ্গে আপোস করেননি। ১৯৭০ সালের নির্বাচন বাঙালি জাতির ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই নির্বাচনে হার-জিতের ওপর অনেকাংশেই নির্ভর করছিল সাত কোটি বাঙালির ভাগ্য। দুই যুগের মতো সময় ধরে বঙ্গবন্ধু যেভাবে পুরো জাতিকে একাট্টা করেছিলেন স্বাধীনতার জন্য, তার ফলাফল দেখার মহেন্দ্রক্ষণ ছিল এটি। নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে হাজার বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলার জন্য জাতি যখন প্রস্তুত, ঠিক এমন সময় নেমে এলো দুর্যোগের ঘনঘাটা। ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে কেঁপে ওঠে বাংলার দক্ষিণাঞ্চল। মানুষের মৃত্যুকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানি জান্তারা যখন ইলেশকশান ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যস্ত, এমন পরিস্থিতিতেও প্রচার-প্রচারণা বাদ দিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির লাশ মাড়িয়ে সামনে এগুনোর নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন তিনি সবসময়। ক্ষমতা, অর্থ কোনোকিছুর মোহেই তিনি তার মানবিক গুণাবলীর সঙ্গে আপোস করেননি।

১২ নভেম্বর সেই ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। নির্বাচনি প্রচার বন্ধ করে বাংলার দুর্যোগ কবলিত মানুষের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কর্মসূচি চালিয়ে যান বঙ্গবন্ধু। এরপর, ২৬ নভেম্বর এক বিশেষ ভাষণ দেন তিনি। সেই ভাষণেই দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা। সেই বছর নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনায় এই চারটি জেলা সফর করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি ১০ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানির কথা ও উপদ্রুত এলাকার বেঁচে থাকা জনগণের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের দৃশ্য বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। সেই সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের চরম ব্যর্থতার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে তিনি বলেছিলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানার দু’দিন আগে সুপারকো ও আবহাওয়া উপগ্রহের মধ্যে খবর পাওয়া সত্ত্বেও উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহের অধিবাসীদের যথাযথভাবে সতর্ক করে দেওয়া হয়নি। হতভাগ্যদের কিছু লোককে অন্তত অন্য স্থানে সরানোর কোনো প্রকার চেষ্টা করা হয়নি। উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে সরকারের অদূরদর্শিতা ও বৈরী মনোভাব প্রসঙ্গ তুলে বলেন, ‘আজাদীর ২৩ বছর পরেও বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য এমনকি পরিকল্পনা পর্যন্ত তৈরি হয়নি। ১০ বছর আগেও একবার ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে এই এলাকার মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। এবার ১০ বছর পর ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা সহস্র গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এক দশক আগে ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধী আশ্রয়স্থল নির্মাণ, সমুদ্র উপকূলবর্তী গ্রামসমূহের পুনর্বিন্যাস এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল। পূর্ণ এক দশক অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও এসব পরিকল্পনা একগাদা প্রকল্পের মধ্যে আটকা পড়ে আছে এবং তা এখনও কার্যকর করা হয়নি। অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশকে প্রকৃতির ধ্বংসলীলার হাত থেকে বাঁচাতে হলে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন অবশ্যই অর্জন করতে হবে। তাহলে আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ঘূর্ণিঝড় দুর্গতদের পুনর্বাসন, গ্রাম পুনর্গঠন যে কোনো জরুরি সমস্যার সমাধান করতে পারব।

আজকের বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশ্বে ‘রোল মডেল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এর পেছনে বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে জাতির পিতার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পরিকল্পনা। দেশবাসীকে ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা করতে হলে যে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে, তা স্পষ্ট করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন: উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ, ঘূর্ণি প্রতিরোধী পর্যাপ্ত আশ্রয়স্থল নির্মাণ, সুষ্ঠু বিপদ সংকেত ব্যবস্থা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করতে হবে। বেঁচে থাকা মানুষগুলোর জন্য চেয়েছিলেন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা, গবাদি পশু, উন্নত লাঙল, বীজ ও কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহসহ দুর্যোগ-পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া। সেদিনের সেই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আর যদি নির্বাচন বানচাল হয়ে যায়, তাহলে ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে নিহত ১০ লাখ লোক আমাদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করে গেছে, তা সম্পাদনের জন্য আমরা যাতে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাঁচতে পারি তার জন্য, আমরা যাতে নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হতে পারি- তার জন্য, প্রয়োজনবোধে আরও ১০ লাখ বাঙালি প্রাণ দেবে।

১৯৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর ৯ ডিসেম্বরে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে যে ভাষণ দেন, সেখানেও ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গ গুরুত্ব পায়। ঘূর্ণিঝড়ে ১০ লাখ লোক নিহত ও ৩০ লাখ বেঁচে যাওয়া মানুষের জীবন-সংগ্রামে তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবকে তিনি নিজেদের জন্য পাহাড়সম কর্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেন। ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু প্রশাসনকে যে ৩৫টি নির্দেশনা দেন, তার মধ্যে ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায় বাঁধ তৈরিসহ সব উন্নয়নমূলক কাজ, সাহায্য-সহযোগিতা, পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন। ১৯৭২ সালেই বঙ্গবন্ধু ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি’ পরিকল্পনা করেন এবং ১৯৭৩ সালে এ কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। আজকের বাংলাদেশে এই কর্মসূচির মাধ্যমে লাখ লাখ স্বেচ্ছাসেবক সেবা দিয়ে যাচ্ছে দুর্গত এলাকার জনগণকে। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে তিনি যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়নের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে তিনি মানুষ ও তাঁর সম্পদ রক্ষায় উঁচু ঢিবি নির্মাণ করতে বলেন। স্থানীয় জনগণ ভালোবেসে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে সেই আশ্রয়স্থলের নাম দেন ‘মুজিব কিল্লা’। দুর্যোগকবলিত মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করার চারিত্রিক এই বৈশিষ্ট্য বঙ্গবন্ধুর স্কুল ছাত্রজীবন থেকেই শুরু হয়। ১৯৪৩ সালে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের দুর্দশা দেখে তার কিশোর হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়। নিজ ডায়েরিতে (অসমাপ্ত আত্মজীবনী) তিনি লিখেছেন- ‘এই সময় শহীদ সাহেব লঙরখানা খোলার হুকুম দিলেন। আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলি লঙরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম। দক্ষিণ বাংলার দুর্দশাপীড়িত মানুষের মাঝে ত্রাণ তৎপরতার জন্য তিনি ঢাকা থেকে কলকাতার বড় বড় নেতার কাছে গেছেন। প্রচণ্ড পরিশ্রমে বঙ্গবন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়েন। তথাপি জনগণের পাশে থাকার সংকল্পে ছিলেন অবিচল।

খবরটি 447 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen