তথ্য প্রযুক্তি ডেস্ক: সারাদেশে অপরাধীকে চিহ্নিত বা শনাক্ত করতে তৈরি করা হচ্ছে ‘জাতীয় ডিএনএ ডাটাবেজ’। জাতীয় ডিএনএ ডাটাবেজ হলে খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতি, দুর্ঘটনায় হতাহত, অপহরণ, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, মাদক কারবারি, প্রতারক, নারীর প্রতি সংহিসতাসহ নানা ধরনের অপরাধ করে নিজেদের আড়াল করতে পারবে না অপরাধীরা। এতে অপরাধী শনাক্ত করা ছাড়াও পলাতক বা নিখোঁজ ব্যক্তিকে শনাক্ত করা, পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব নির্ধারণ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে অনেক সময় মারা যাওয়া ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। অপরাধ করার পর নিজেদের আড়ালে রাখতে নানা কৌশলী পথ বেছে নেয় অপরাধীরা। পলাতক বা নিখোঁজ অপরাধীকে খুঁজে বের করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পর আলামত সংগ্রহ করে রাখলে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষার মাধ্যমে অপরাধী শনাক্ত সহজ হয়ে যাবে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মাধ্যমে ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং শুরু করা হয়েছে। পুলিশ ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে জাতীয় ডিএনএ ডাটাবেজ প্রোফাইলিংয়ের মাধ্যমে সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি সূত্রে এ খবর জানা গেছে।

            ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ১২ আগস্ট ‘ডিএনএ আইন-২০১৪’ (২০১৪ সালের ১০ নম্বর আইন) এর ধারা ২০ অনুযায়ী, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদফতর’ নামে একটি অধিদফতর স্থাপনের জন্য প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। প্রতিনিয়ত ডিএনএ পরীক্ষার গুরুত্ব বাড়তে থাকায় এই ল্যাবরেটরিকে অধিদফতরে রূপান্তরের জন্য ডিএনএ আইন পাস করে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর গেজেট প্রকাশ করেছে সরকার। ২০১৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় ‘ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদফতর’ গঠন ও অধিদফতরের জন্য ৬৪টি পদ সৃষ্টির সম্মতি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একজন মহাপরিচালক (ডিজি), পরিচালক ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাসহ ৫০টি পদ সৃষ্টির এই অনুমোদন দেয়া হয় তখন। এছাড়া অধিদফতরের আওতায় ঢাকায় তিনটি ল্যাবেরটরি ও সাতটি বিভাগীয় ল্যাবরেটরির জন্য আরও ৪২টি পদ সৃষ্টির অনুরোধ করা হয়। বর্তমানে ৬৪টি পদের অনুমোদন রয়েছে। ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে ২০০৬ সালের জুন থেকে ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪ বছরে ৬ হাজার ১১৪টি মামলার ২২ হাজার ৫৪৪টি নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়েছে। ২০০৯ সালে বিডিআর বিদ্রোহে হত্যার পর যেসব সেনা কর্মকর্তার চেহারা বিকৃত করে দেয়া হয়েছিল, সেই সেনা কর্মকর্তাদের পরিচয়ও শনাক্ত হয়েছিল এই ল্যাবরেটরিতে। এদের মধ্যে কর্নেল গুলজার উদ্দিন আহমেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল এলাহি মানজুর চৌধুরী, মেজর আহমেদ আজিজুল হাকিম এবং বিডিআরের ডিএডি ফসিহ উদ্দিন চৌধুরীও ছিলেন। এছাড়া ২০১২ সালে সাভারের তাজরীন গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডে সম্পূর্ণ পুড়ে যাওয়া ৪১টি মৃতদেহের পরিচয় শনাক্ত করা হয়। ২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসে নিহতদের দেহগুলো শনাক্ত করা হয় ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে। ঘৃণ্যতম অপরাধ দমনে ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির মাধ্যমে পুলিশ ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে সহায়তা দেয়া হয়। এরই মধ্যে এই ল্যাবরেটরির কার্যক্রম সারাদেশে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিভাগীয় সদরের সাতটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট এমএজি ওসমানি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর ল কলেজ হাসপাতাল এবং ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এসব বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি স্থাপন করা হয়েছে। বিভাগীয় ল্যাবরেটরিগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গৃহীত মামলার নমুনা সংগ্রহ করে ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে থাকে। এই ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পিতৃত্ব অথবা মাতৃত্বের প্রমাণ, বংশের ধারা প্রমাণ, বিভিন্ন দুর্যোগে ও দুর্ঘটনায় নিখোঁজ এবং মৃত ব্যক্তির পরিচিতি উদ্ধারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে থাকে।

            ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির এক কর্মকর্তা বলেছেন, ২০০৬ সালে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টোরাল প্রোগ্রামের আওতায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ডিএনএ ফরেনসিক ল্যাবরেটরির কার্যক্রম শুরু করা হয়। পরে ২০১০ সালের এপ্রিলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসের নিউক্লিয়ার মেডিসিন ভবনের ১১ তলায় আরেকটু বৃহত্তর পরিসরে এই ল্যাবরেটরি স্থানান্তর করা হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন ন্যাশনাল ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে এতদিন সীমিত আকারে ডিএনএ পরীক্ষা করা হচ্ছিল। এই পরীক্ষা আরও বৃহত্তর পরিসরে করার লক্ষ্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে অধিদফতর প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। জাতীয় ডিএনএ ডাটাবেজ তৈরির কাজও শুরু করা হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তিকে শনাক্ত, পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব নির্ধারণ, নারী ও শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার সঙ্গে জড়িত অপরাধী শনাক্তসহ বিভিন্ন স্পর্শকাতর মামলার তদন্তে সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক এসিড (ডিএনএ) পরীক্ষা। কীভাবে ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে, এ পরীক্ষার ডাটাবেজ কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে, পরীক্ষার পদ্ধতি, পরীক্ষার গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, ল্যাবরেটরির মান, প্রশাসনিক ব্যবস্থা সব বিষয়ে একটি কাঠামোয় আনতে এ বিষয়ে আইন করা হয়েছে। আইনটিতে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি বা সংস্থা সরকারের অনুমোদন ছাড়া ডিএনএ পরীক্ষা বা সংরক্ষণ করতে পারবে না। এ আইন ভাঙলে সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের পাশাপাশি তিন লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি অধিদফতর করা হচ্ছে। অধিদফতরের আওতায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা কমিটি হচ্ছে, যাতে সদস্য হিসেবে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরাও থাকবেন।

 চলতি বছর ২৭ আগস্টে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধিদফতরের অফিস ভবন স্থাপনসহ বিভিন্ন বিষয়ে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরার সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় কয়েকটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অধিদফতরের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কমপ্লেক্স ভবন তৈরি করার মতো জমি বরাদ্দের বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি পাঠানো হয়। এই বিষয়ের অগ্রগতি মনিটরিং করার সিদ্ধান্ত হয়। এর আগে অস্থায়ীভাবে জাতীয় মহিলা সংস্থার ভবনে রুম বরাদ্দের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়। ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের নিয়োগ বিধি ও সাংগঠনিক কাঠামো এবং অফিস সরঞ্জামাদি অনুমোদনের জন্য অর্থ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বরাবর চিঠি পাঠানো হয়েছে। ডিএনএ ল্যাবরেটরি ব্যবস্থাপনা অধিদফতর প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় কাজগুলো গুছিয়ে নিতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন বিভাগের যুগ্ম সচিব কামরুল হাসান খানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। অধিদফতরের জন্য ঢাকায় জমি, ভবন প্রতিষ্ঠাসহ আনুষঙ্গিক কাজ চলছে। পূর্ত মন্ত্রণালয়ও এ নিয়ে কাজ করছে।

            ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরির এক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বলেছেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কোন ব্যক্তি বা ভিকটিম, অভিযুক্ত কিংবা সন্দেহভাজন এবং অপরাধ সংঘটিত হওয়ার ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত নমুনার ডিএনএ-কে তুলনা করে তাদের মধ্যে মিল বা অমিল খুঁজে বের করা হয়। প্রতিটি মানুষের ৯৯ দশমিক ৯ ভাগ ডিএনএ একই। পার্থক্য বা পরিবর্তনশীলতা বিদ্যমান থাকে মাইক্রোস্যাটেলাইট সিকোয়েন্স বা শর্ট টেনডেম রিপিট (এসটিআর) হিসেবে। আধুনিক ডিএনএ প্রোফাইলিং পদ্ধতি এই পরিবর্তনশীলতার একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে আনে। যাকে সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে প্রকাশ করা হয়। যমজ সন্তান ছাড়া পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের ডিএনএ প্রোফাইল অদ্বিতীয় বা ইউনিক। অর্থাৎ কারও সঙ্গে কারও মিল নেই।

খবরটি 808 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen