স্বাস্থ্য ডেস্ক: পায়ের দীর্ঘ মেয়াদী ঘা কী করবেন: পায়ের দীর্ঘমেয়াদী ঘা যাকে মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় বলা হয় ননহিলিং আলসার। এই রোগে অনেকে ভুগছেন। কোন কিছুতে এই ঘা ভালো হচ্ছেনা। তাদের কী করনীয় তা নিয়েই আজকের লেখা।
প্রথমেই আসি, কী কী কারনে এই রোগ হয়: এই রোগের প্রধান কারনগুলো আমরা দুইভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথম কারন হচ্ছে ধমনীর ব্লকজনিত সমস্যা যাকে আমরা বলি ইস্কেমিয়া বা রক্ত সঞ্চালন ঠিকমতো হচ্ছে না। এক্ষেত্রে ঘা শুকনা থাকে। দ্বিতীয় কারন হচ্ছে ভেনাস আলসার বা শিরায় সমস্যাজনিত কারন। এক্ষেত্রে ঘা থেকে রস পড়ে, পা ফোলা থাকে। ভেনাস আলসার মূলত দুই শ্রেনীর রোগীর হয়ে থাকে।
১. যাদের দীর্ঘদিন থেকে জার্নি করলে বা দীর্ঘক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলে বা বসে থাকলে পা ফুলে যাওয়ার ইতিহাস থাকে। যাকে মূলত ক্রনিক ভেনাস ইনসাফিসিয়েন্সি (CVI) বলে।
২. আরেক শ্রেনীর রোগী হচ্ছে  যাদের হঠাৎ করে পা ফুলে যাওয়ার ইতিহাস থাকে। যাকে বলা হয় ডিপ ভেইন থ্রোম্বোসিস (DVT) বা মাংসের গভীরের শিরা বন্ধ।
দীর্ঘ মেয়াদী ঘা ডায়াবেটিস রোগীদের একটা খুবই সাধারন সমস্যা যাকে বলা হয় ডায়াবেটিক ফুট আলসার। এটা মূলত ইস্কেমিয়া বা রক্ত সঞ্চালন কমে যাওয়া, নিউরোপ্যাথি বা পায়ের অনুভুতি কমে যাওয়ার কারনে এবং ফুট ডিফরমেটি বা পায়ের আকার এবং গঠনের পরিবর্তনের কারনে হয়ে থাকে। এছাড়াও কিছু ক্রনিক ইনফেকশনের কারনেও পায়ের দীর্ঘ মেয়াদী ঘা হতে পারে যেমন টিউবারকুলার আলসার বা যক্ষা জনিত কারনে পায়ের এই রোগ হতে পারে। আরও নানাবিধ কারনে এই রোগ হতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদী পায়ের ঘায়ের ঝুকির কারনগুলোর মধ্যে ধুমপান, বার্জার্স ডিজিজ, অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস, ডিসলিপিডেমিয়া, ক্রনিক ভেনাস ইন্সাফিসিয়েন্সি, মাংসের গভীরের শিরা বন্ধ হয়ে যাওয়া অন্যতম।
কিভাবে বুঝা যাবে এই দীর্ঘ মেয়াদী ঘা: প্রথমত রোগীর ইতিহাস থেকে ধারনা পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত ঘা দেখে বুঝা যায় এটা শুকনা ঘা বা ইস্কেমিক আলসার নাকি ঘা থেকে রস পড়ছে এবং সাথে পা ফোলা আছে কিনা যা ভেনাস আলসারের লক্ষন। শুকনা ঘা যাদের থাকে তারা অনেক সময় অনেক আগে থেকে হাঁটতে সমস্যার কথা বলে থাকেন।  কিছুদূর হাঁটালে পায়ের মাংশপেশী ব্যথা হয়। পা ধরে আসে। তখন তাকে বিশ্রাম নিতে হয়। তারপর আবার হাটতে পারে। যতদিন যেতে থাকে তার হাঁটার এই দূরত্বটা কমে আসে। একসময় স্বাভাবিক চলাফেরা করতে পারেনা এমনকি বিশ্রামে থাকলেও ব্যথা কমে না। যাকে আমরা রেস্ট পেইন (rest pain) বলি। যাদের দীর্ঘদিন থেকে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে তাদের একসময় পায়ের অনুভুতি কমে যায় বা অনুভুতি থাকে না। তখন যেকোন আঘাত পেলে সে টের পায়না। সেখান থেকে আস্তে আস্তে আলসার বা ঘা হয় যা সহজে শুকায়না। সাথে যোগ হয় ইনফেকশন। তখন রক্তে গ্লুকোজের পরিমান আরও নিয়ন্ত্রনের রাইরে চলে যায় এবং ঘায়ের অবস্থা আরও অবনতির দিকে যেতে থাকে। যেসব ঘা থেকে রস পড়ে সেসব রোগীরা অনেকদিন থেকে পা ফোলার কথা বলে। চিকিৎসকরা রোগীর পায়ের পালস পরীক্ষা করলেও একটা প্রাথমিক ধারনা পেয়ে যায় এটা কি রক্ত সঞ্চালন ঘাটতির জন্য হচ্ছে নাকি শিরায় সমস্যার জন্য হচ্ছে।
কী কী পরীক্ষা করাবেন এই ধরনের রোগীরা: রক্তের কিছু পরীক্ষা করালে ইনফেকশনের মাত্রা, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বুঝা যায়। ঘা থেকে রস নিয়ে (culture & sensitivity) পরীক্ষা করলে বুঝা যাবে কোন ধরনের জীবানু দিয়ে ইনফেকশন হয়েছে এবং কোন এন্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিৎসা করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে। পায়ের আল্ট্রাসাউন্ড পরীক্ষা যাকে ডুপ্লেক্স বলা হয় সেটা করলে বুঝা যাবে এটা কি ধমনীর ব্লকজনিত সমস্যা নাকি শিরায় সমস্যা। রোগ সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্য আমরা  অনেকসময় রোগীকে এঞ্জিওগ্রাম করতে বলি। হার্টের যেমন এঞ্জিওগ্রাম করা যায় পায়েরও তেমন এঞ্জিওগ্রাম করা যায়। এই এঞ্জিওগ্রাম তিন পদ্ধতিতে করা যায় ।
১। কনভেনশনাল এঞ্জিওগ্রাম যা ক্যাথল্যাবে করা হয়।
২। সিটি এঞ্জিওগ্রাম যা সিটিস্ক্যান মেশিন দিয়ে করা হয়। এবং
৩। এম আর এঞ্জিওগ্রাম।
এঞ্জিওগ্রাম করে খুব সহজে বোঝা যায় কোথায় রক্ত সঞ্চালন কম আছে বা বন্ধ আছে এবং কোন রোগীর কি চিকিৎসা নিতে হবে সে ব্যপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। আর যাদের শিরায় সমস্যা তাদের ভ্যানোগ্রাম পরীক্ষা করে রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। এটাও এঞ্জিওগ্রামের মতো তিন পদ্ধতিতে করা যায়। তবে এঞ্জিওগ্রাম বা ভ্যানোগ্রাম পরীক্ষা করার পূর্বে রোগীর কিডনীর অবস্থা (S. Creatinine পরীক্ষাকরে) জেনে নিতে হয়। কারন এই পরীক্ষার ফলে অনেকের কিডনীর কার্যকারিতার উপর প্রভাব পড়তে পারে।
কী চিকিৎসা নিবেন: যারাএই দীর্ঘ মেয়াদী পায়ের ঘা রোগে ভুগছেন তাদেরকে অবশ্যই একজন ভাসকুলার সার্জারী বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসানিতেহবে। রোগের ধরন, তীব্রতা, রোগীর শারিরীক অবস্থা এবং রোগীর সক্ষমতার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে। যারা শুকনা ঘা বা ইস্কেমিক আলসার বা রক্ত সঞ্চালনের সমস্যার জন্য ভুগছেন তাদেরকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাটা ছেড়া না করে অত্যাধুনিক চিকিৎসা করা যায় যাকে এন্ডোভাসকুলার চিকিৎসা বলা হয়। আক্রান্ত নালী কে বেলুন দিয়ে প্রসারিত করে (baloon angioplasty) বা রিং (stent) বসিয়ে চিকিৎসা করা যায়। এছাড়া কাটাছেড়া করে যেমন ইন্ড-আরটারেকটমি (End- arterectomy) অথবা বাইপাস করেও চিকিৎসা করা যায়। কিছু মেডিসিন ও থেরাপীর মাধ্যমেও চিকিৎসা করা হয়। যারা ভেনাস আলসারে ভুগছেন তাদের রোগ নিশ্চিত হয়ে কোন শিরায় কী ধরনের সমস্যা তার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক চিকিৎসা দেয়া যায়। যেমন যাদের গভীরের শিরা বন্ধ থাকে তাদের শিরাতে রিং (stent) বসিয়ে চিকিৎসা করা যায়। যারা ক্রনিক ভেনাস ইনসাফিসিয়েন্সির জন্য ভেরিকোস ভেইনে ভুগছেন তাদেরকে কাটাছেড়া না করে লেজারের মাধ্যমে চিকিৎসা করা যায়। এছাড়াও ভেনাস আলসারের জন্য বিশেষ ধরনের ব্যান্ডেজ ব্যবহার করা হয় যাকে বলা হয় চারস্তরের ব্যান্ডেজ (four layer bandage)। রোগীকে পায়ের দিক উঁচু রাখতে বলা হয়। এক ধরনের বিশেষ রকমের মোজা ব্যবহার করতে বলা হয়। এছাড়াও কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলতে বলা হয় এবং ব্যায়াম করতে বলা হয়। কাজেই যারা এই রোগে ভুগছেন তাদের অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে চিকিৎসা নিতে হবে। নিয়মিত ড্রেসিং করাতে হবে, উপযুক্ত এন্টিবায়োটিক ও রক্তে গ্লুকোজের পরিমান নিয়ন্ত্রনে রাখতে হবে। কারন এই ঘায়ের জটিলতা থেকে পায়ে গ্যাংরিন হতে পারে। যার ফলে অনেক সময় আক্রান্ত আঙ্গুল কেটে ফেলতে হয়। এমনকি অনেক সময় পাও কেটে ফেলতে হয়। তবে আঙ্গুল বা পা কাটার পূর্বে অবশ্যই একজন ভাসকুলার সার্জনের পরামর্শ নিবেন। অনেক সময় এই ঘা থেকে ইনফেকশন খুব দ্রুত রক্তে ছড়িয়ে পড়ে। যাকে আমরা সেপ্টি সেমিয়া বলি। যার ফলে রোগীর মৃত্যুও হতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ের ব্যপারে বিশেষ ভাবে যত্নবান হতে হবে।
সর্বপরি এই রোগ সম্পর্কে সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং উপযুক্ত সময়ে যথাযথ ভাবে চিকিৎসা নিলেই এই রোগের বিভিন্ন রকম জটিলতা থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্ভব।
ডাঃ জুবায়ের আহমেদ
এম.বি.বি.এস. এম.এস (কার্ডিও ভাসকুলার ও থোরাসিক সার্জারী)
ফেলোশীপ ট্রেনিং ( ন্যানশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল), সিংগাপুর
সহকারী অধ্যাপক ও সহযোগী কনসালটেন্ট
ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট।

খবরটি 1,850 বার পঠিত হয়েছে


আপনার মন্তব্য প্রদান করুন

Follow us on Facebookschliessen
oeffnen